Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
চাই শুধু একটু সদিচ্ছা আর সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত মন

আসুন, আজ পণ করি...

এই নববর্ষে সেই ভূত যেন আমাদের ঘাড়ে চেপে পেয়ে বসেছে। গাজনের শিব-সঙ্গী নন্দী, ভৃঙ্গিদের সাক্ষী রেখেই নববর্ষে পদার্পণ করল এই বঙ্গের বাঙালি।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

ভূতরূপ সিন্ধু-জলে গড়ায়ে পড়িল বৎসর। কিন্তু ভূত কি শুধুই অতীত? নিছক কালের চিহ্ন? না। বাঙালির নিত্য ব্যবহৃত শব্দভান্ডারে ‘ভূত’ বরং অন্য ব্যঞ্জনায় উপস্থিত। সে ভয় দেখায়। আতঙ্ক তৈরি করে। অন্ধকার বাড়িয়ে দেয়। ঘাড়ও মটকায়!

এই নববর্ষে সেই ভূত যেন আমাদের ঘাড়ে চেপে পেয়ে বসেছে। গাজনের শিব-সঙ্গী নন্দী, ভৃঙ্গিদের সাক্ষী রেখেই নববর্ষে পদার্পণ করল এই বঙ্গের বাঙালি। বৎসরের আবর্জনা দূর হওয়া তো দূরের কথা, সর্ব অঙ্গে মলিনতা মেখে আমরা নতুন বছরকে আবাহন করছি।

এক দিন ছিল, যখন পয়লা বৈশাখ জুড়ে থাকত উৎসবময়তা। বারো মাসে তেরো পার্বণের তালিকায় বাংলা বছরের প্রথম দিনটি নিজস্ব মহিমায় স্থান করে নিয়েছিল। নতুন জামা, দোকানে দোকানে হালখাতা, মিষ্টিমুখ, উষ্ণ আন্তরিকতা, মঙ্গলঘট, পঞ্চপল্লবে তৈরি থাকত নতুনকে স্বাগত জানানোর আয়োজন।

দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা বছর তার গরিমা হারিয়েছে। নববর্ষ নাকি এখন ইংরেজি ক্যালেন্ডারের একটি দিন মাত্র। নিয়মরক্ষার চেয়ে বেশি কিছু হয় না। বড় জোর এক দিন অনভ্যস্ত ধুতি-পা়ঞ্জাবিতে সেজে বাঙালি ভোজ। যদিও এই সব আক্ষেপ এত দিনে গা-সওয়া। কিন্তু হিসাবের নতুন খাতা খোলার লগ্নে হাতে কী রইল, তা ভুললে চলে না।

নিছক সালতামামির খতিয়ান নয়। শুধু ভেবে দেখার জন্য একটু পিছনে তাকানো যাক। কিছু দিন ধরে চার দিকে যে সব কাণ্ড ঘটে চলেছে, সমাজ ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক ছন্দ যে ভাবে ধাক্কা খাচ্ছে, ভাবনায় যত দীর্ঘ ছায়া ফেলছে ভয় এবং অবিশ্বাস, তা কি বঙ্গভূমির গৌরবের ধ্বজা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে? প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র। আজ নববর্ষের পুণ্য প্রভাতে নিজেদের ঐতিহ্য এবং অহঙ্কারের ঢাক পেটানোর দিনে এই আত্মসমীক্ষা বোধ হয় জরুরি।

রাজ্যে ২০১১ সালে যখন পরিবর্তন এল, তখন তার সঙ্গী ছিল কিছু স্বপ্নও। লোক বিশ্বাস করেছিল, অতীতের ভুলগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে তৈরি হবে ভবিষ্যতের পথ। কিন্তু সাত বছর পেরিয়ে আবার চার পাশে কেমন এক অস্থিরতার বাতাবরণ। গুঞ্জন উঠছে, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! তবে কেন?

সব কিছুতেই রাজনীতি এবং চক্রান্ত দেখতে বাঙালি বেশ পটু। কেউ কোনও প্রশ্ন বা প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারণ করলেই তাতে কেউ কেউ দ্রুত চক্রান্তের গন্ধ টের পেয়ে যান। যাঁরা শাসকের আসনে থাকেন, গন্ধবিচারের ক্ষমতাও আবার তাঁদেরই বেশি থাকে! নিজেদের কোনও কাজ বা সিদ্ধান্তের জন্য ভুল স্বীকার অবশ্য নৈব নৈব চ। দল-মত-রং নির্বিশেষে এটা মোটামুটি স্বতঃসিদ্ধ। সেখানে কোনও পরিবর্তন আসেনি।

অনেকেরই মনে আছে, ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে ‘সূর্যোদয়’-এর প্রতিবাদে কলকাতার পথে সেই ঐতিহাসিক মিছিলের কথা। দলীয় পতাকা ছেড়ে সে দিন যাঁরা মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তাধারার মানুষজন বড় কম ছিলেন না। তবু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র রক্ষার দাবিতে সেই মিছিলকে ‘অরাজনৈতিক’ হিসাবেই মান্যতা দেওয়া হয়েছিল। যার প্রথম সারিতে ছিলেন শঙ্খ ঘোষ।

মিছিলের বার্তাকে নস্যাৎ করতে গিয়ে সে দিনের শাসকবর্গ অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই রাজনৈতিক আক্রমণের পথ নেন। বাকি যা, তা ইতিহাস। যার ফল ফলতে শুরু করেছিল ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই।

সাত বছর পরে আরও এক বার পথে নেমেছেন শঙ্খ ঘোষের মতো ব্যক্তিরা। নববর্ষের মাত্র সাত দিন আগে। আরও এক বার তাঁরা সমস্বরে বলছেন— সন্ত্রাস বন্ধ হোক, সম্প্রীতি ফিরুক, গণতন্ত্র বাঁচুক। মিছিলে কিছু মুখ বদলেছে। অনেকে আগে ছিলেন, এখন নেই। অন্য এক দল আবার আগে না থাকলেও এখন বেশ সক্রিয়। সেই সঙ্গেই আবহে রয়েছে রাজনীতি। কিন্তু মূল চিন্তার বিষয় হল, মাত্র সাত বছরের মধ্যে আরও এক বার একই রকম ডাক দিয়ে রাজ্যে একই রকম মিছিল সংগঠিত করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে কেন? শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বঙ্গজনেদের পর্যবেক্ষণ হল, সময়টি খুব সুখের নয়।

আসলে যা হচ্ছে, তার অনেক কিছুই না-হলে নববর্ষের প্রথম সকালটি সুন্দরতর হত। হল না। কয়েক দিন আগের টাটকা স্মৃতিতে রয়েছে, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আঁচে আমাদেরই প্রতিবেশীরা তটস্থ দিন কাটাচ্ছেন। আমরা দেখেছি, ধর্মীয় জিগির তুলে শিশু-কিশোরদের হাতে খোলা তরোয়াল দিয়ে মিছিলে সামিল করা হচ্ছে। আমাদের বিবেককে চাবুক মেরে দাঙ্গায় পুত্রহারা ইমামকে বলতে হয়েছে, হিংসা দিয়ে হিংসার মোকাবিলা করা যায় না।

পরিবর্তনের বঙ্গে এমন সব অবাঞ্ছিত ছবি দেখার পরে মনে ভয় হয়। বাংলার এই অবয়ব আমাদের কি ফের কালো ইতিহাসের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে! কাদের হাত ধরে কোথায় চলেছি আমরা? ‘আত্মঘাতী’ বাঙালি যথেষ্ট আতঙ্কিতও।

ঠিক যেমন, আমরা আরও এক বার দেখতে চাই না ক্ষমতা কুক্ষিগত করার তাড়নায় সন্ত্রাস এবং হানাহানির রাজনীতি। অথচ পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেই ভয়ের আবহাওয়া আবার ফিরে এসেছে। পরিস্থিতি এখনও গরম। আগামী দিনে আরও কী ঘটবে, কত রক্ত ঝরবে, জানা নেই। সাধারণ মানুষ শঙ্কিত।

মানতেই হবে, সন্ত্রাসের ভোট পশ্চিমবঙ্গ আগেও দেখেছে। অতীতে ক্ষমতাসীনেরা কয়েক দশক জুড়ে বুক ফুলিয়ে এই কাজটিই করেছে। বিলম্বে হলেও তার ফলও তারা পেয়েছে। মানুষ তাদের ক্ষমা করেননি। কিন্তু যারা ‘উত্তম’, তারাও যদি ক্রমে ‘অধম’-এর পদানুসরণ করার পন্থা নেয় এবং তা ক্রমাগত প্রশ্রয় পেতে থাকে, পরিস্থিতি তখন আর কারও নিয়ন্ত্রণে থাকে না। উন্মত্ত ভূতেদের উপদ্রব দেখতে দেখতেই বাঙালির এ বার নববর্ষে পা।

কেন এই অসহিষ্ণুতা? কেন এত হিংসা? বাতাসে কেন এত বিষ? আমরা কি পরস্পরের উপর বিশ্বাস হারাচ্ছি? যাঁরা কান্ডারি, আস্থা ও বিশ্বাসের পরিস্থিতি তৈরি করার বড় দায়িত্ব কিন্তু তাঁদেরই থাকে। কারণ তাঁরা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে দায়বদ্ধ। সেখানে শিথিলতা ঘটলে বিষয়টি শিষ্টের দমন ও দুষ্টের পালনে পর্যবসিত হয়। শরীর শক্তপোক্ত না হলে যেমন রোগ সহজে বাসা বাঁধার সুযোগ পায়, ব্যাপারটি তেমনই।

অথচ পরিবর্তনের বাংলায় ভাল কাজ তো কম হয়নি। সাত বছরে অনেকটাই বদলেছে রাজ্যের চেহারা। শহর থেকে গ্রাম, সেই বদলের মুখচ্ছবি স্পষ্ট। একের পর এক জনকল্যাণমুখী প্রকল্পে বিভিন্ন স্তরে বহু মানুষ সরাসরি লাভবান। তাঁদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। ‘উন্নয়ন’ হয়তো প্রকৃত অর্থেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে। তবু কেন মানুষের উপর এত অবিশ্বাস? কেন তাঁদের সুবুদ্ধির প্রতি এত অবিচার?

ভূতে ভর করলে বুঝি হিত-কথা তেতো লাগে! এটা আরও ভয়ঙ্কর প্রবণতা। আত্মশুদ্ধি ছাড়া এই রোগের দাওয়াই নেই।

নতুন বছর তো নতুন শপথেরও দিন। নতুন বছরে কে কী করতে চান, নিজেকে কী ভাবে বদলে নিতে চান সেই সব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ভরিয়ে দিতে শিখেছি আমরা। ইংরেজি বর্ষবরণে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ‘নিউ অ্যাজেন্ডা’ বলাটা ইদানীং বেশ চালু কায়দা।

এ বার এই ভূত-প্রিয় অন্ধকারের বাংলা নববর্ষে এক বারের জন্য আমরা কি নিজেদের অ্যাজেন্ডা ঠিক করে নিতে পারি? ‘নব বৎসরে করিলাম পণ’ বলে শপথ নিয়ে বলতে পারি কি: এ পাপ আর না!

চাইলেই পারি। দরকার শুধু একটু সদিচ্ছা, সততা, সঙ্কীর্ণতামুক্ত, প্রতিস্পর্ধাহীন মানসিকতা। দরকার ‘আমি’ ছেড়ে ‘আমরা’ হয়ে ওঠার উদারতা। কারণ মানুষের গণতন্ত্রে ‘আমরা’ বড় গুরুত্বপূর্ণ। এটুকু পারলে বাঙালির নববর্ষ এ বার সত্যিই ‘শুভ’ হয়ে উঠবে। যার গর্বিত ভাগীদার হব আমরা সবাই।

যদি তা না হয়? তা হলে ভূতেদের পোয়াবারো! ভবিষ্যৎও তাদের। আমাদের জন্য শুধু অন্ধকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Poila Baisakh Bengali New Year Resolutions
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE