Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
পাঁচ বছরে ভারত স্থান পাবে উন্নত দেশের তালিকায়

নিজে বিশ্বাস করছেন নাকি!

পাপী মনে দেবদ্বিজে ভক্তির ঘোর অনটন, এমনকী সিনেমা হলে জাতীয় সংগীত বাজলে নিয়ম মাফিক উঠে দাঁড়াই, বাহান্ন, না কি তিপ্পান্ন, সেকেন্ড বাধ্য নীরবতা পালনও করি, কিন্তু মিথ্যে বলব না, ভক্তিভাব জাগে না।

প্রার্থনা: কেদারনাথ মন্দিরের সামনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ২০ অক্টোবর ২০১৭। ছবি: প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সৌজন্যে।

প্রার্থনা: কেদারনাথ মন্দিরের সামনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ২০ অক্টোবর ২০১৭। ছবি: প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সৌজন্যে।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

খবরটা ভেসে উঠেই হারিয়ে গিয়েছে। সে রকম তো কতই যায়। কিন্তু এটা ঠিক আর পাঁচটা খবরের মতো নয়। দেওয়ালির পরের দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী কেদারনাথের মন্দিরে পুজো দেন এবং তার পরে একটি বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতায় ‘এই পুণ্যভূমি থেকে ভোলে বাবার আশীর্বাদ’ প্রার্থনা করে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, ‘‘২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির আগে উন্নত ভারত গড়ার যে স্বপ্ন আমি দেখি, তা পূরণের জন্য নিজের সর্বশক্তি নিবেদন করব।’’ কেদারনাথ মহাদেব এই বাণী শুনে কতটা সন্তুষ্ট, জানি না, তবে নরেন্দ্র মোদীর ভক্তরা নিশ্চয়ই মুগ্ধ হয়েছেন। আর সেই কারণেই এটা একটু বিস্ময়ের ব্যাপার যে, তাঁরা এমন একখানা স্বপ্নের কথা ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে প্রচার করলেন না, কোটি কোটি স্মার্ট ফোনে এখনও ‘উন্নত ভারত’ অ্যাপ ডাউনলোড হল না! জ্যোতির্বলয় কি ফিকে হচ্ছে?

পাপী মনে দেবদ্বিজে ভক্তির ঘোর অনটন, এমনকী সিনেমা হলে জাতীয় সংগীত বাজলে নিয়ম মাফিক উঠে দাঁড়াই, বাহান্ন, না কি তিপ্পান্ন, সেকেন্ড বাধ্য নীরবতা পালনও করি, কিন্তু মিথ্যে বলব না, ভক্তিভাব জাগে না। প্রধানমন্ত্রীর ভাবশিষ্যরা অপরাধ নেবেন না, তাঁর ওই পবিত্র শপথখানি শুনে অবাধ্য মগজে, ভক্তি নয়, একটি প্রশ্নের উদয় হল। উন্নত ভারত— ডেভেলপড ইন্ডিয়া— বলতে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন?

ভারতের ভিতরে যে অনেকগুলো ভারত, যার কোনওটা ক্যালিফর্নিয়ার মতো, কোনওটার দশা আফ্রিকার সাহারার দক্ষিণবর্তী দেশগুলোর মতো বা করুণতর, সেই প্রসঙ্গ এখন থাক। সামগ্রিক বা গড়পড়তা হিসেবের কথাই হোক। উন্নত দেশ বলতে প্রধানত সাহেবসুবোদের পশ্চিম দুনিয়াকেই বুঝে এসেছি, তার সঙ্গে জাপান ইত্যাদি দু’চারটি অ-শ্বেতাঙ্গও স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসেবের খাতায় মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে যে চতুর্বর্গ ভাগ করা হয়— উচ্চ, উচ্চ-মধ্য, নিম্ন-মধ্য এবং নিম্ন— তার প্রথম সারিতে, এশিয়া থেকে হংকং, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো গুটিকয়েক দেশের নাম আছে। চিনও আপাতত দ্বিতীয় সারিতে, উচ্চ-মধ্য কোঠায়। ভারতের মাথাপিছু আয় নিম্ন-মধ্য, মানে তিন নম্বর সিঁড়িতে, পাকিস্তান বাংলাদেশ প্রমুখ প্রতিবেশীর সঙ্গেই। অন্য তালিকাও আছে, যেমন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানব উন্নয়ন সূচকের হিসেব। সেখানে ভারত মাঝারি-উন্নয়নের সারিতে, তবে তাতে আহ্লাদের কারণ নেই, কারণ চিন আছে উচ্চ-উন্নয়নের কোঠায়, এবং তার ওপরে আছে অতি-উচ্চ উন্নয়নের সুপার-ক্লাস। মানে, হরেদরে ভারত সেই থার্ড ক্লাসেই।

বস্তুত, সামগ্রিক মানব উন্নয়নই হোক আর শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো বিশেষ বিশেষ জীবনকুশলতাই হোক, যে মাপকাঠিতেই বিচার করি, শ’দুয়েক দেশের তালিকায় ভারত ১৩০-এর আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। প্রসূতি ও শিশুর মৃত্যু বা অপুষ্টির ব্যাপারে তো আমরা এই হতদরিদ্র দক্ষিণ এশিয়াতেও লাস্ট বেঞ্চে বসে আছি— শ্রীলঙ্কা তো বটেই, বাংলাদেশ, এমনকী নেপালেরও পিছনে। এক পাকিস্তান এ সব বিষয়ে আরও খারাপ অবস্থায় থেকে মহান ভারতের মুখরক্ষা করেছে। সে জন্য কেবল নরেন্দ্র মোদীকে দোষ দিলে অন্যায় হবে, তাঁর পূর্বসূরিরাও এই কলঙ্কের কারিগর। কিন্তু তাই বলে পাঁচ বছরে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন? ভোলে বাবা বর দিলে কী ম্যাজিক হবে জানি না, তবে সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয় খুব জোরে দৌড়লেও প্রথম সারিতে ওঠার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত, এ পরীক্ষায় ডবল প্রোমোশন নেই।

তা হলে পাঁচ বছরের মধ্যে উন্নত ভারত তৈরির কথাটা কি, আবারও, জুমলা? কিন্তু নবাগত নায়কের দেওয়া জুমলা আমজনতা যতটা খায়, তিন বছর পরে ও জিনিস যে আর ততটা উপাদেয় থাকে না, সেই সত্য তো বালকেও জানে। তবে কি কথাটা প্রধানমন্ত্রীর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল? অসম্ভব নয়। মুখেন মারিতং জগৎ যাঁদের স্বভাব, তাঁরা অনেক সময়েই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে একটা কথার ফানুস উড়িয়ে দেন। ভুললে চলে না, নরেন্দ্র মোদীর উত্থান বিজ্ঞাপনী রাজনীতির ফানুস উড়িয়েই, এবং বিজ্ঞাপনের গোমাতা ইদানীং এভারেস্টে ওঠেন, এই সে দিনই দেখলাম ফ্যাশন ডিজাইনিং শেখানোর এক নয়া প্রতিষ্ঠান বলছে, সেখানে নাকি এক মুহূর্তে মিকেলাঞ্জেলো তৈরি হয়! এক মুহূর্তে মিকেলাঞ্জেলো তৈরি হলে, পাঁচ বছরে উন্নত ভারতই বা নয় কেন?

সত্যি বলতে কী, বিদেশি ব্যাংক থেকে কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেক ভারতবাসীর পকেটে দেড় লক্ষ টাকা ভরে দেব, পাঁচ বছরে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করে দেব, ভোলে বাবার বরে ২০২২ সালের মধ্যে উন্নত ভারত গড়ে দেব— এই সব গালগল্প যদি প্রধানমন্ত্রী স্রেফ জুমলা হিসেবে পরিবেশন করে থাকেন, কিংবা তত কিছুও না ভেবে স্রেফ হাততালি শোনার লোভে বলে দিয়ে থাকেন, দৈনন্দিন সাড়ে বত্রিশ ভাজার দেশে সে এক রকম চলে যাবে।

কিন্তু মনের মধ্যে অন্য একটা ভয় ক্রমশ বাড়ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন খুব জোর গলায় দেশের অর্থনীতি নিয়ে এই সব কথা বলেন, তার মানে বুঝে বলেন তো? পাঁচ বছরে কৃষকের আয় দ্বিগুণ হতে পারে না বা ভারত উন্নত দেশে পরিণত হতে পারে না, সেটা তিনি আদৌ বোঝেন তো? বুঝেশুনে অলীক স্বপ্ন ফেরি করলে অন্যায় লোক-ঠকানো হয় বটে, তবে তাতে ক্ষতি তুলনায় কম। কিন্তু প্রবলপরাক্রমশালী প্রধানমন্ত্রী যদি ওই সব আগডুম-বাগডুম বিশ্বাস করেন, তবে তো খুবই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

যত দিন যাচ্ছে, এ চিন্তা তত ঘনীভূত হচ্ছে। ৮ নভেম্বর ২০১৬-র সেই ভয়ানক লগ্নটির দিকে ফিরে তাকিয়ে মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী সে দিন হয়তো সত্যিই ভেবেছিলেন, দুম করে চোদ্দো আনা নোট বাতিল করে দিলে কালো টাকার রাক্ষস-খোক্কসরা হাঁউমাউ করে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে দলে দলে ছুটে এসে প্রাণ বিসর্জন দেবে। অথচ, অর্থনীতি কী ভাবে চলে এবং কী ভাবে চলে না, সে বিষয়ে একটা সাধারণ বোধ থাকলেই বোঝা যায়, ও ভাবে কোনও কাজের কাজ হয় না, বরং খামকা একটা বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়, বছর ঘুরে গেলেও দেশের মানুষ তার ধাক্কা সামলে উঠতে পারে না, যেমন এখনও পুরোপুরি পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিতে প্রাজ্ঞ হওয়ার দায় নেই, কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানের অভাব হলে বিপদ।

না কি, তিনি একটা কানাগলিতে ঢুকে পড়েছেন? অহংকারের কানাগলি? তিন বছর পরে হয়তো তিনি মনে মনে টের পাচ্ছেন যে কিচ্ছু মিলছে না, কিন্তু সেটা স্বীকার করলে তাঁর সমস্ত-সমস্যার-সমাধানে-পারংগম সর্বজ্ঞ ভাবমূর্তিটি মুহূর্তে ধসে পড়বে, এই আশঙ্কায় তিনি ‘আমি কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাই না’ বলে হুংকার দিচ্ছেন? প্রয়োজনে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া নিশ্চয়ই সুনেতার কাজ। কিন্তু অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে কেবল নিজেকে বাহাদুর প্রমাণ করার তাড়নায় উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত নেওয়ার বুদ্ধিকে সুবুদ্ধি বলা যায় না, কারণ তার ফলে সবচেয়ে বিপদে পড়বেন সাধারণ মানুষ। এই সহজ কথাটা তাঁর সহকর্মী বা উপদেষ্টারা তাঁকে জানাচ্ছেন না কেন, সেই প্রশ্নও উঠবে। তাঁদের মধ্যে অর্থনীতির সম্যক জ্ঞানের ঘোর অনটন, সে এক সমস্যা বটে, কিন্তু সাধারণ বোধের অভাব নেই নিশ্চয়ই। আন্দাজ করতে পারি, সত্য কী, জেনেও তাঁরা নীরব, কারণ অপ্রিয় সত্য বললে,কী জানি কী হয়!

আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দেওয়া নিষ্ফল। তবু, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ, তাই বলি, তিনি বরং তাঁর শক্তিমান প্রতিবেশীটিকে দেখে শিখতে পারেন। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির উনিশতম কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং নিজের নাম পার্টির সংবিধানে খোদাই করে দিয়েছেন। সেই ‘শি চিনফিং ভাবনা’র একটা প্রধান কথা হল: দেশ ‘মোটামুটি সমৃদ্ধি’র লক্ষ্যে এগোবে। মোটামুটি কেন? সিকি শতকের লাগামছাড়া আয়বৃদ্ধি বিরাট উন্নতি এনেছে বটে, কিন্তু বিপুল সমস্যাও সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে অসাম্যেরও লাগামছাড়া বৃদ্ধি ঘটেছে। তাই এ বার রাশ টানতে হবে, না হলে সামলানো যাবে না। ওঁরাও ‘উন্নত চিন’-এর স্বপ্ন দেখছেন, কিন্তু, ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও, ২০৩৫ সালের আগে নয়।

কাণ্ডজ্ঞান অতি উপকারী বস্তু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE