ফাইল চিত্র।
অকুস্থলে যাঁহারা ছিলেন, তাঁহারা যদি বাবাকে না মারিয়া থাকেন, তবে বাবাকে মারিল কে?— গোরক্ষকদের আক্রমণ চলাকালীন নিহত অলওয়রের দুগ্ধব্যবসায়ী পেহলু খানের পুত্র ইরশাদের জিজ্ঞাসা: অভিযুক্ত ছয় জন ‘গোরক্ষক’ বেকসুর খালাস পাইয়া গিয়াছেন, ভাল কথা, কিন্তু সে ক্ষেত্রে পেহলু খান তবে জীবিত মানুষ হইতে মৃত মানুষে পরিণত হইলেন কী উপায়ে? এই অত্যন্ত সংগত ও মৌলিক জিজ্ঞাসার কোনও উত্তর রাজস্থানের পুলিশ দিতে পারে নাই, রাজস্থানের সরকারও পারিবে না। সিআইডি আলাদা করিয়া পুলিশের কাছে অনুরোধ করিয়াছে চার্জশিট হইতে ছয় অভিযুক্তের নাম বাহির করিয়া দিতে, তখন বোঝাই যায়— একমাত্র আশা, রাজ্যের বাহিরে প্রশ্নটিকে লইয়া যাওয়া। ভিন্রাজ্য, অর্থাৎ কোনও অ-বিজেপি রাজ্যের চৌহদ্দিতে গিয়া পড়িলে সেখানকার পুলিশ প্রশাসন হয়তো উত্তর দিলেও দিতে পারে। অভিযোগকারীদের আশ্বাস, সুপ্রিম কোর্ট অবধি মামলাটি যাইবে। সুতরাং বিজেপি-শাসিত রাজস্থান হইতে মামলাটি বাহির হওয়া পর্যন্ত পেহলু খানের শোকগ্রস্ত পরিবার মানিয়া লউন, আক্রমণকারীরা কেহই আক্রান্তকে মারে নাই— নো ওয়ান কিলড্ পেহলু খান।
শেষ বাক্যবন্ধটির পিছনে যে ইতিহাস, তাহাই জানাইয়া দেয়, এমন ঘটনা এ দেশে একেবারেই অশ্রুতপূর্ব নহে। নাগরিক সমাজ ইতিমধ্যেই দিব্য জানিয়া গিয়াছে, কী ভাবে সাক্ষাৎ ঘাতকদের বেকসুর খালাস করিয়া দেওয়া যায়, উচ্চ মহলের রাজনৈতিক হাতযশ কেমন করিয়া কাজ করে। বস্তুত, নাগরিকরা বলিতে পারেন, বিজেপি-শাসিত রাজস্থানে কি ইহাই স্বাভাবিক নহে যে, পুলিশ প্রশাসনের হাতে গোরক্ষার মহৎ প্রকল্প শাস্তিপ্রাপ্ত হইবে না? প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শুনিয়া যাঁহারা আশায় বুক বাঁধিতেছিলেন যে গোরক্ষা-তাণ্ডব এ বার কমিতেও পারে, রাজস্থান পুলিশ এক ঘায়ে তাঁহাদের উচিত শিক্ষা দিয়াছে। আদালতের কথায় যাঁহারা প্রত্যাশা করিতেছিলেন যে রাজ্য প্রশাসনগুলি গোরক্ষা নামক অশান্তি-সংঘর্ষ কমাইতে সক্রিয় ভূমিকা লইবে, তাঁহারাও বুঝিয়া গিয়াছেন, হিন্দুত্ব-ভাবাদর্শকল্পে কেন্দ্র-রাজ্য ভেদাভেদ নাই। সত্যই তো, বিজেপি যখন কেন্দ্রে রাজ্যে যুগপৎ আসীন, পুলিশ কি গোরক্ষকবাহিনীকে সত্যই অপরাধী হিসাবে ঘোষণা করিতে পারে? দেশব্যাপী ভক্তসমাজ তবে নেতাদের ছাড়িয়া দিবে? ভোটের বাক্স অক্ষত রাখিতে দিবে? পেহলু খানের হত্যাস্থলে গিয়া কিছু মানবাধিকার সংগঠন প্রতিবাদ-ধরনা করিতে চাহিয়াছে বলিয়াই গণরোষ তাঁহাদের পিছু লইয়াছে। এমত পরিবেশে অভিযুক্তরা খালাস না পাইলে গণরোষ কী আকার লইতে, ভাবা কি কঠিন? অঙ্কটি এতই সহজ যে ফলাফল ভিন্ন হইলেই বিস্ময়ে বাক্যহারা হইতে হইত।
রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী হয়তো ভাবিতেছেন, রাখে হাইকম্যান্ড মারে কে। আর হাইকম্যান্ড কী ভাবিতেছে? বাস্তবিক, এই সুপরিচিত রাজনৈতিক ক্ষমতালাঞ্ছিত সমাজেও ‘সাহসিকতা’ ও ‘স্বচ্ছতা’র নব দৃষ্টান্ত তৈরি করিতেছেন নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়া তিনি একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিয়া যাইতেছেন। গোরক্ষা বিষয়ে নিজের স্বর্ণালি নীরবতাটিই বহন করিয়া গেলে তবু বলিবার কিছু ছিল না, কিন্তু এক দিকে তাঁহার ব্যথিত স্বরে গোরক্ষা তাণ্ডবের সমালোচনা, অন্য দিকে গোরক্ষাকারীদের এই শাস্তিহীন প্রতিকারহীন দাপট— প্রধানমন্ত্রী পদটি বাস্তবিকই এক ভিন্ন মহিমায় অন্বিত। নরেন্দ্র মোদী বিশ্বাস করেন, নাগরিক সমাজ, অর্থাৎ ভোটার সমাজ, তাঁহার এই প্রতিশ্রুতিসর্বস্ব যাত্রায় বিনা প্রশ্নে সহগামী হইবে। তাঁহার সমালোচনা করিবে না, তাঁহার নেতৃত্বকে প্রশ্ন করিবে না। তাঁহার বিশ্বাসের প্রেক্ষিতে ভারতীয় সমাজ কী ভাবিতেছে, তাহাই এখন দেখিবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy