Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Editorial News

মানবতার অবক্ষয় বলে দায় এড়িয়ে যাওয়ার সময় কিন্তু আর নেই

সভ্যতা তো মানব জীবনের আধার। মানবতা বলতে যা বুঝি, তারও আধার। এই সভ্যতা তথা এই সমাজই জন্ম দেয় আমাদের, এই সভ্যতা তথা এই সমাজই গড়েপিটে নেয়, অন্তিম পরিণতিতেও পৌঁছে দেয়। সভ্যতার সঙ্গেই যাত্রা আমাদের, সভ্যতার সঙ্গেই সফর গোটা মানব সমাজের। অতএব, সভ্যতার অগ্রগতির সামগ্রিক অর্থ মানুষেরই অগ্রগতি। একটা উত্তর এই রকম।

বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিন্তু নয় এ। প্রায়শই ইতিউতি এমন অমানবিকতার প্রমাণ মিলছে। প্রতীকী ছবি।

বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিন্তু নয় এ। প্রায়শই ইতিউতি এমন অমানবিকতার প্রমাণ মিলছে। প্রতীকী ছবি।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৭ ০৫:১৩
Share: Save:

খুব বিভ্রান্ত হতে হচ্ছে মাঝে-মধ্যেই। মানুষের অগ্রগতি আর মানব সভ্যতার অগ্রগতি কি মোটের উপর একই? প্রশ্ন জাগছে। কিন্তু, প্রশ্নটার দ্বিধান্বিত উত্তর আসছে।

সভ্যতা তো মানব জীবনের আধার। মানবতা বলতে যা বুঝি, তারও আধার। এই সভ্যতা তথা এই সমাজই জন্ম দেয় আমাদের, এই সভ্যতা তথা এই সমাজই গড়েপিটে নেয়, অন্তিম পরিণতিতেও পৌঁছে দেয়। সভ্যতার সঙ্গেই যাত্রা আমাদের, সভ্যতার সঙ্গেই সফর গোটা মানব সমাজের। অতএব, সভ্যতার অগ্রগতির সামগ্রিক অর্থ মানুষেরই অগ্রগতি। একটা উত্তর এই রকম।

অন্য উত্তরটা বলছে, সভ্যতার অগ্রগতির অর্থ হল আমাদের পারিপার্শ্বিকতার অগ্রগতি বা নিরন্তর বদল। কিন্তু সমগ্র মানব সমাজের অগ্রগতি তাতে হয় না। কোনও ক্ষেত্রে অগ্রগতি কিছু মানুষের হয়, কোনও ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শ্রেণির অগ্রগতি হয়।

মানবতাকে বার বার লাঞ্ছিত হতে দেখেছি বলেই বোধ হয় এই রকম দ্বিধাবিভক্ত একটা উত্তর পাচ্ছি, একটা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ছি। দিল্লিতে জনবহুল রাস্তায় সর্বসমক্ষে দুর্ঘটনা ঘটল। গাড়ির ধাক্কায় গুরুতর জখম ব্যক্তিকে ফুটপাথে পড়ে কাতরাতে দেখা গেল। কেউ সাহায্যের জন্য এগোলেন না। ১২ ঘণ্টা জখম অবস্থায় পড়েছিলেন ওই ব্যক্তি। সেই ফাঁকে কেউ তার মোবাইল হাতিয়ে নিল, কেউ নিল পকেটে থাকা যত্সামান্য টাকা। কিন্তু, জখম ব্যক্তির চিকিত্সার ব্যবস্থা করতে এগিয়ে এলেন না কেউ।

এর পরে কী করে বলব, সভ্যতার প্রভূত অগ্রগতি হয়েছে? সে কথা যদি বলি, তা হলে তো স্বীকার করতে হবে যে মানবতাও অনেক উন্নত হয়েছে। তা যে সর্বৈব হয়নি, দিল্লির ছবিতে তার প্রমাণ নেই কি?

বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিন্তু নয় এ। প্রায়শই ইতিউতি এমন অমানবিকতার প্রমাণ মিলছে। সর্বসমক্ষে তরুণীকে বার বার ছুরিকাঘাত করা হচ্ছে, কেউ এগোচ্ছেন না। প্রবল গ্রীষ্মে প্রবীণ নাগরিক রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, কেউ পাশে দাঁড়াচ্ছেন না, পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে মৃত্যু। দুর্ঘটনাগ্রস্ত মানুষ রাস্তায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন, তাঁর আর্তি চোখে পড়ছে না, পকেটে রাখা সেলফোনটায় নজর পড়ছে। অজস্র দৃষ্টান্ত রয়েছে। দেশের সব প্রান্তে রয়েছে, বিশ্ব জুড়েই এমন ঘটছে। ন্যূনতম মানবতা বোধটুকু লোপ না পেলে কি এমন হয়?

মানবতাকে যদি সভ্যতার শিক্ষা বলে ধরে নিই, তা হলে সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে মানবতারও উন্নতি হওয়ার কথা। মানুষের ভিতরে সহমর্মিতা, সহানুভূতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ভালবাসা ইত্যাদির মানোন্নয়ন ঘটার কথা। কালের নিয়মে আরও উত্কৃষ্ট, উন্নততর মানবতার দিকে ধাবমান হওয়ার কথা। সংবেদনশীলতায় আরও প্রাবল্য আসার কথা। তেমনটা ঘটছে কি?

অনেকেই হয়তো বলবেন, মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে। তা হলে কিন্তু ধরে নিতে হবে মানবতারও অবক্ষয় হচ্ছে। অর্থাত্ এই সভ্যতা তার সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করে ফেলেছে। আর তার অগ্রগতির সম্ভাবনা নেই। এ বার শুধু ক্ষয়, ধীরে ধীরে ক্ষয়, উন্নতির চেয়ে দ্রুত বেগে ক্ষয়। তেমনটা মেনে নিতে কি আমরা প্রস্তুত? নিশ্চয়ই প্রস্তুত নই। আমরা হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে বিশ্বাস করি, মানব সভ্যতা অসীম সম্ভাবনাময়। এখনও অনেক পথ এগনো বাকি তার। সুতরাং, অবক্ষয়ের তত্ত্ব খাড়া করে হিসেবটা মেলানো যাবে না, সমস্যার মূলে পৌঁছতে হবে। উত্কৃষ্ট মানবতা কেন এখনও চারিয়ে দেওয়া যায়নি সমাজের প্রতিটা অংশে, ন্যূনতম মানবতার বোধটাও কেন এখনও জাগিয়ে তোলা যায়নি অনেকের মধ্যেই, তা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে, সেই দায়িত্বটা কিন্তু প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষকে সমান ভাবে নিতে হবে। সভ্যতাকে ত্রুটিমুক্ত রাখার দায়িত্ব তাঁদেরই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE