তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের সাকিন বীরভূম। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনেরও তাই। কিন্তু তাঁহারা দুই বিপরীত জগতের অধিবাসী। তাই রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘উন্নয়ন-বিরোধী’ চিহ্নিত করিলেন অনুব্রত। তাঁহার দল তৃণমূল কংগ্রেসে অবশ্য বিদ্বজ্জনের অভাব নাই। তবু পঞ্চায়েত নির্বাচনে অনুব্রত-কথিত উন্নয়নের সংজ্ঞাকে কেহ প্রশ্ন করেন নাই। নানা জেলায় বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দিতে দেন নাই তৃণমূলের নেতারা। বাংলার শতাধিক গ্রামে একটিও বিরোধী প্রার্থী নাই, অতএব একটিও ভোট পড়িবে না। অমর্ত্য সেনের সংজ্ঞা মানিলে অবশ্য স্পষ্ট হয়, এ রাজ্য রহিয়াছে উন্নয়নের ঠিক বিপরীতে। কারণ ‘উন্নয়ন’ শব্দটির অর্থ তিনি করিয়াছেন ‘স্বাধীনতা।’ কোনও ব্যক্তি যাহা মূল্যবান বলিয়া মনে করে, তাহা করিতে বা পাইতে সে কতটা সক্ষম, তাহাই বিচার্য। যে দেশ তাহার নাগরিকের সক্ষমতা যত বাড়াইয়াছে, সে দেশের নাগরিক তত স্বাধীন। তাই সে দেশ তত উন্নত। অমর্ত্য সেনের মতটি গোটা বিশ্বে সাদরে গৃহীত। কেননা মানুষ জানে, তাহার রোজগার বাড়িতে পারে, তাহার শহরের রাজপথ চওড়া হইতে পারে, সেখানে আলোর বন্যাও বহিতে পারে। কিন্তু নাগরিককে যদি নতমস্তকে শাসকের সকল তর্জন সহ্য করিতে হয়, নিজের মত প্রকাশের সুযোগ না থাকে, তবে সে জীবন অর্থপূর্ণ হইতে পারে না। উন্নয়নের সহিত জীবনে সার্থকতার কোনও যোগ যদি না থাকিল, তবে তাহা প্রার্থিত হয় কী রূপে?
রাজনৈতিক স্বাধীনতা উন্নয়নের একটি অন্যতম মাত্রা। নির্বাচনে প্রার্থী হইবার, নিজের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করিবার, নিজের মতামত সর্বসমক্ষে জানাইবার, সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে যোগ দিবার স্বাধীনতা রাজনৈতিক সক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। ভারতের মানুষ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে প্রাণ দিয়াছিলেন স্বাধীনতা পাইবার জন্য। সে দিন ব্রিটিশরা যুক্তি দিয়াছিল, তাহারা দরিদ্র ভারতকে দক্ষ প্রশাসন ও শিল্পের মাধ্যমে উন্নয়নের পথ দেখাইতেছে। সরকার নির্বাচনের ক্ষমতা দাবি করিয়া সেই মসৃণ পথকে কেন কর্দমাক্ত করিতে চায় কিছু বিভ্রান্ত মানুষ? আজ ঠিক সেই কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি বাংলার গ্রামে গ্রামে। শাসকের বিরোধীকে ‘প্রগতির বিরোধী’ বলিয়া প্রচার করিয়া, নাগরিক স্বাধীনতার বিপরীতে সরকারি উন্নয়নকে প্রতিপক্ষ খাড়া করিয়া এক ছায়াযুদ্ধ চলিতেছে।
এক একটি নির্বাচন আসে, আর এক একটি শব্দ অর্থহীন হইয়া যায়। ২০১১ সালে এ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের পর অর্থ হারাইয়াছে ‘পরিবর্তন’। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে অর্থ হারাইল ‘উন্নয়ন।’ অনুব্রত মণ্ডলের ব্যবহৃত অর্থে ‘উন্নয়ন’ হইয়া দাঁড়ায় কংক্রিটের রাস্তা, বৃহৎ হাসপাতাল, একশো দিনের কাজ, খাদ্যসাথী প্রভৃতি সরকারি প্রকল্প। দারিদ্র অনুন্নয়নের প্রধান কারণ, তাহার নিরসনের জন্য এমন প্রকল্প প্রয়োজন, সন্দেহ নাই। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতার পরিবর্তে ভর্তুকির চাল বা সুলভ ঔষধ দিতে চাহিলে তাহা ‘গরু মারিয়া জুতা দান’-এর মতোই অর্থহীন হইয়া ওঠে। শাসককে বুঝিতে হইবে দুইটি কথা। এক, রাজ্যবাসী তাহাদের উন্নয়নের দায়িত্ব দিয়াছে, ঠিকা দেয় নাই। দুই, অনুন্নয়ন বাছিবার অধিকার রাজ্যবাসীর আছে। কিন্তু তাহার ভোট নিষ্ফল করিবার অধিকার সরকারের নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy