Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ

এখন ‘হায় হায়’ করে কী হবে?

যে বাঙালিরা আমেরিকায় বহু দিন ধরে থাকেন আর দু’বছর অন্তর এক বার কলকাতায় আসেন বাপ-মা’কে দেখতে এবং সাউথ সিটির ফ্ল্যাটটা এখন বিক্কিরি করলে কত প্রফিট হবে হিসেব করতে, আর মাথা নাড়িয়ে চুকচুকিয়ে আফশোস করতে, আহা গো, স্টেটটার কী অবস্থা করে রেখেছে, এগুলো কি ক্লাউন না লিডার— তাঁদের খুব ঝামেলা হয়ে গেল।

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

যে বাঙালিরা আমেরিকায় বহু দিন ধরে থাকেন আর দু’বছর অন্তর এক বার কলকাতায় আসেন বাপ-মা’কে দেখতে এবং সাউথ সিটির ফ্ল্যাটটা এখন বিক্কিরি করলে কত প্রফিট হবে হিসেব করতে, আর মাথা নাড়িয়ে চুকচুকিয়ে আফশোস করতে, আহা গো, স্টেটটার কী অবস্থা করে রেখেছে, এগুলো কি ক্লাউন না লিডার— তাঁদের খুব ঝামেলা হয়ে গেল। ও-দেশে বাংলার কাউকে দেখতে পেলেই তাঁরা দুশ্চিন্তায় ডলার-চকচকে গালের পেশি কাঁপিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কী হবে! এ বার, বাংলার লোক তাঁদের ওই গাল টিপে ছলছলে চোখে ফুকারি উঠতে পারেন, বাপু, আগে ভাবো তোমাদের কী হবে। আমাদের লিডাররা অশিক্ষিত, ইংরিজি বলতে পারে না, ঘুষের দিকে ঢলে আছে, সব ঠিক, কিন্তু তোমরা এত কাড়া-নাকাড়া অন্তে কাকে নির্বাচন করলে বাপ? পৃথিবীর মহত্তম দেশে, আলিঙ্গনের অভয়ারণ্যে, যেথা উদারতা ও প্রগতি হাত-ধরাধরি করে টানা ‘সবারে করি আহ্বান’ গেয়ে চলেছে কিঞ্চিৎ কড়াপাক গিটার সহ, সেখানে এমন এক জনকে সিংহাসনে বসালে, যে কুচুটে রাজমিস্ত্রির মতো তক্ষুনি পাঁচিল তুলতে শুরু করে দেয়? একটা দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কথা বলতে গেলেও ফোন মাঝপথে ধড়াম করে কেটে দেয়! যেন প্রেমিকার সঙ্গে মন-কষাকষি!

দোষ তো ট্রাম্পের নয়। তিনি আগাগোড়া, এতটুকু রাখঢাক না করে, অসভ্য নির্লজ্জ ভাষায় ভঙ্গিতে, চাঁচাছোলা দ্ব্যর্থহীন বলেছেন, তিনি কেমন মানুষ ও কী চান। তাঁর ক্যাম্পেনের থিম: ঘেন্না কর, থুতু দে, মার সবাইকে, তাড়া সবাইকে। মেক্সিকানরা রেপিস্ট, চিনারা শয়তান, ভারতীয়রা মার্কিনদের চাকরি খায়, মুসলিমগুলো টেররিস্ট, আর হ্যাঁ, নারীগুলো ভোগ্যবস্তু। তা, এই লোক ক্ষমতায় এলে কী করবে? ফুল্লকুসুমিত মানবিকতা ও কল্যাণময়তার চাষবাস? তা হলে তো তার ‘ইন্টিগ্রিটি’-ই থাকবে না! সে বলল, আমায় ক্ষমতা দাও, আমি তোমায় মুসলিমশূন্য স্বর্গ দেব— তার পর কুর্সি পেয়ে সে কী বলবে? মুসলিমদের বুকে টানো? বরঞ্চ সে ক্ষমতা পাওয়ার আগে যে-আপদ ছিল, এখনও সে-আপদই আছে। আর যারা আমেরিকার রা-রা-রা ডিমোক্রেসির ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে পিটিয়ে হাতে বাত ফলিয়ে ফেলেছিল, তাদের ভাবার সময় এসেছে— যে দেশে বুঝেশুনে এই লোককে লাখে লাখে মানুষ ঝাঁপিয়ে ভোট দেয়— সেখানকার লিবার্টি-মহোদয়ার কি উচিত নয়, ঊর্ধ্বমশাল-টি অবিলম্বে স্বখাত সলিলে চুবিয়ে, রিটায়ার?

হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য বিরুদ্ধ-মিছিল হয়েছে ট্রাম্পের অভিষেকের দিন, ওয়াশিংটন নিউ ইয়র্ক আরও কোথায় কোথায়, এ কূল ও কূল ছ’কূল উপচে পড়েছে, মেয়েরা ‘পুসিহ্যাট’ পরে ট্রাম্পকে দুয়ো দিয়েছেন, গ্লোরিয়া স্টাইনেম বলেছেন গণতন্ত্রের এমন বহিঃপ্রকাশ জীবনে দেখেননি, ম্যাডোনা বলেছেন তিনি ভেবেছেন হোয়াইট হাউস উড়িয়ে দেওয়ার কথা, রাস্তাঘাট সেলফোনের সিগনাল সব ব্লক হয়ে গিয়েছে প্রতিবাদের ভিড়ে, নির্ঘাত সব্বার মনে সিক্সটিজের আঁচ ডিলান-বায়েজ ধাঁচ আহ্লাদে মুন্ডু তুলছিল, বাঃ, সাচ্চা আন্দোলন করিচি! ট্রাম্প এ সম্বন্ধে একটা টুইট করেছিলেন, যার মর্ম: সে কী, হেথা একটা নির্বাচন হয়েছিল না? নির্বাচনে অবশ্য ট্রাম্প প্রায় তিরিশ লক্ষ ভোট কম পেয়েছেন, আমেরিকার গণতন্ত্রের জটিল প্রক্রিয়ায় জিতে গেছেন, কিন্তু সে কথা ছেড়ে দিলেও টুইট-সূত্র ধরে একটা প্রশ্ন তোলা যায়: ট্রাম্প যখন দিনের পর দিন নারীদের সম্পর্কে (এবং অন্যদের সম্পর্কে) অসভ্য কথাগুলো বলছিলেন, তখন এই আকাশপাতাল ভাসানো মিছিল কোথা ছিল? এই প্রকাণ্ড কোরাস-হাহাকার? তখন এগুলো করলে হয়তো নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারত! তখন তাঁকে ক্লাউন ঠাউরে চুটকি গড়ে আদ্ধেকে কর্তব্য সারছিল কেন? ‘নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকায় এক ভদ্রলোকের কথা আছে, যিনি মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন, আসলে এখন এই মিছিল করা হচ্ছে স্রেফ আমাদের আত্মতৃপ্তির জন্যে। একদম তা-ই। নইলে, অভিষেকের দিন, তখনও একটাও কাজ করেনি যে, তার বিরুদ্ধে তুমি এত খেপে মিছিল করছ কেন? আর যদি জানোই, সে সাংঘাতিক খারাপ কাজ করবে, অসহিষ্ণুতার বুলডোজার চালাবে— সমকামী, ট্রান্সজেন্ডার, নারী, অভিবাসী, শরণার্থী, যে যেখানে কোনও ভাবে প্রান্তিক এবং সুতরাং অধিক যত্ন ও মনোযোগের অধিকারী, সব্বার সর্বনাশ করে ছাড়বে, তা হলে এ আন্দোলন তো অনেক আগে থেকে অনেক ভেবেচিন্তে গড়ে তোলা উচিত ছিল মা!

কেউ বলছে, আসলে লোকে ট্রাম্পকে একেবারেই সিরিয়াস প্রার্থী হিসেবে গণ্য করেনি, অনেকে ভোটই দিতে যায়নি ‘ও হিলারি তো জিতবেনই’ ভেবে, আর শেষ তিনটে বিতর্কের পর তো ট্রাম্পের হার প্রায় স্বতঃসিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এগুলো আলস্যের যুক্তি। তোমার গণতন্ত্র যদি হয় শিক্ষিত গণতন্ত্র, তোমাকে জাগ্রত থাকতে হবে। বিশেষত উগ্র জাতি-অহং’এর হুহু ও চটজলদি আকর্ষণের বিরুদ্ধে। হিটলারও নির্বাচনে জিতেছিলেন। প্রতিটি মানুষ মূলগত ভাবে সাম্প্রদায়িক, চেতনার উখোয় ঘষে ঘষে তাকে প্রতি দিন এই গাদ তুলতে হয়। যদি আজ বাংলায় কেউ ‘আমরা বাঙালি’ সংগঠন প্রবল নেতৃত্বে গড়ে তোলে ও চিল্লায়: এ রাজ্য থেকে সব অবাঙালিকে মেরে তাড়াও শুধু বাঙালিকে চাকরি দাও ব্যবসা দাও, ভোটের আগে টক-শো এবং প্রবন্ধে তাকে হুড়িয়ে গালাগাল দেওয়া হবে, এবং তার পর হয়তো সে লাখ লাখ ভোটে জিতবে। সব মানুষ ভাবতে ভালবাসে, তার দুর্দশার জন্যে তার অক্ষমতা দায়ী নয়, অন্য লোকের অন্যায় অনুপ্রবেশ দায়ী। ব্রেক্সিটেরও মূল কথা এ-ই, ট্রাম্পের জয়েরও।

সাধারণত এ সব যারা বিশ্বাস করে, তাদের বাস্তবজ্ঞান থাকে না, ঔচিত্যের ধারণাও নয়, আর সবচেয়ে বেশি তারা ভালবাসে অশিক্ষা ও সরাসরি তার দাপুটে উচ্চারণ। তাই এদের প্রিয় মোড়ল এমন কেউ, যিনি বলেন, আমি তর্ক-যুক্তি জানি না, কিচ্ছু পড়ি না শুনি না, পুতুপুতু ভাবনাচিন্তাচর্চা পুরো ধাস্টামো, কে বলে বিশ্ব-উষ্ণায়ন হচ্ছে, ধুস, তা হলে এত ঠান্ডা পড়ছে কী করে, দে ক্লাইমেটের চুক্তিগুলো ছিঁড়ে!

খারাপ কথা নয়। দিকে দিকে না-শেখারই উৎসব। ফিল্ম শিখে ফিল্ম করতে হয় না। গান শিখে গান গাইতে হয় না। পলিটিক্সেই বা ডেকোরাম, এটিকেট জানতে হবে কেন? পড়াশোনা করতে হবে কেন? এ দিক থেকে ট্রাম্প তাঁদেরই ক্যাপ্টেন, যে-নেতানেত্রীরা পৃথিবীর দিকে দিকে অশিক্ষার ফ্ল্যাগ প্রকাণ্ড পুঁতছেন। যে পণ্ডিতরা চিরকাল আক্ষেপ করেছেন, সব ক্ষমতা এলিটদের হাতে থাকবে কেন, তাঁরা এখন ‘সাবঅলটার্ন’দের অলরাউন্ড জয়ে কিছু হতচকিত: জন-অধিনায়করা কেউ ভুল উচ্চারণ বাগিয়ে নিম্নবর্গ হওয়ার গর্বে স্ফীত, কেউ কোটি টাকার গরমে ইতরোমোর আস্ফালনে সিদ্ধ। ট্রাম্প তাঁর গাড়ির স্পর্ধিত চাকায় সব নীতি গুঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছেন, কেন মস্তান হব না? কে বললে প্রেসিডেন্টকে ভদ্র হতে হবে? আমি সব ন্যায়প্রথা অস্বীকার করি, শুধু জানি, সবাই এ দেশের ভালমানুষির সুযোগ নিয়েছে অ্যাদ্দিন, এ বার আমার বাজেমানুষিতে ভিলেনরা কাঠে-কাঠ পড়বে।

গুগ্‌ল অ্যাপ্‌ল-রা যত মামলা করুন, নোবেলজয়ীরা যত সই করুন প্রতিবাদপত্রে, আদালত যত পথ আটকাক, নেতার এই রাফ-টাফ মূর্তিখান বহু মানুষের কাছে ত্রাতা হিসেবে তাঁর বেদি পোক্ত করে। ‘এই একটা লোক আন্তর্জাতিক ন্যাকামিকে কেয়ার না করে মুখের ওপর আসল সত্যিটা ছুড়ে দেয়!’ আমেরিকায় যা মিছিল হয়েছে, বোধহয় তার চেয়ে বেশি লোক তলে তলে এই বেতোয়াক্কা ট্রাম্পকে সমর্থন করছে, আনন্দে নাচছে। এ জিনিস যদি ছড়িয়ে পড়ে, ঘৃণা ও আঘাতের প্রতি দেশকর্তার প্রশ্রয় যদি হাওয়ায় ওড়ে, তবে ঘোষিত রাষ্ট্রনীতি থাক আর না-থাক, পথচারীর পাসপোর্ট পকেটে ঝুলুক আর লকেটে, রেসিস্ট হাঙ্গামা মারধর টিটকিরি খুব দূরে নেই। তখন হয়তো কিছু লোককে— ‘ইস রে নেটিভ, তুই কী হট্টমেলার দেশে থাকিস!’ করুণাঘন পোজ ত্যাগ করে— এই পোড়া কলকাতায় ব্যাক করতে হবে। সাউথ সিটির ফ্ল্যাটটা বেচে দেননি তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE