Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মাথা কাটলেই রোগ সারবে?

বিশ্বাস যেমন এক দিনে গড়ে ওঠেনি, ভাঙেওনি এক দিনে। দিনের পর দিন আমাদের সন্তান রক্তাক্ত হয়ে ফিরেছে স্কুল থেকে, প্রিয়জন ন্যূনতম পরিষেবাটুকু না পেয়ে শেষ হয়ে গিয়েছে।

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৮ ০৬:১০
Share: Save:

শব্দটা ছিল বিশ্বাস, যার ধাপে-ধাপে পা রেখে তৈরি হয়েছিল নানা মাত্রার অসংখ্য সম্পর্ক আর বিনিময়। আমরা সন্তানকে যে নির্ভয়ে ছেড়ে এসেছিলাম স্কুলের দরজায়, অসুস্থ প্রিয়জনকে হাসপাতালের বিছানায়, সে-সব তো ওই বিশ্বাসেরই দরুন। আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। তড়িঘড়ি সংশোধন করতে গিয়ে আমরা বদলে ফেলছি এত দিনের অভ্যাস। যে-কোনও ঘটনার প্রতিবাদে এখন আমাদের হাতে উঠে আসে লাঠি, ডাক্তার-পুলিশ-শিক্ষক কেউই বাদ যান না।

বিশ্বাস যেমন এক দিনে গড়ে ওঠেনি, ভাঙেওনি এক দিনে। দিনের পর দিন আমাদের সন্তান রক্তাক্ত হয়ে ফিরেছে স্কুল থেকে, প্রিয়জন ন্যূনতম পরিষেবাটুকু না পেয়ে শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আইনের পথে কোনও অপরাধেরই কোনও মীমাংসা হয়নি। বিশ্বাস করব কাকে আর কেনই বা করব! আমাদের কাছে ডাক্তাররা এখন ডাকাত, পুলিশরা ঘুষখোর, শিক্ষকরা সুযোগসন্ধানী। তাই যে-কোনও দুর্ঘটনার সংবাদটুকু পেলেই এখন দল বেঁধে চড়াও হই। আমাদের ভিতরের অসহিষ্ণুতা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, এই সুযোগ! অপরাধটা গৌণ হয়ে একটা সময়ের পর প্রতিবাদটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়। তাই রাস্তায় আহতকে সাহায্য করার লোকের দেখা না পেলেও হাসপাতালে মৃত মানুষের জন্য ভাঙচুর করার লোকের অভাব হয় না। যাঁরা সেই প্রতিবাদে অংশ নেন, দেখা যায় তাঁরা অনেকে মূল ঘটনাটা জানেনই না। অর্থাৎ ব্যাপারটা আদৌ প্রতিবাদই নয়, বরং এক রকমের প্রতিশোধ! একটি ঘটনাকে কেন্দ্রে রেখে আমরা যে যার নিজের নিজের প্রতিশোধ নিয়ে চলি। শিক্ষকরা এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন।

এই হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া ও তার নিন্দা নিয়ে অনেক দরকারি কথা ইতিমধ্যেই বলা হয়ে গিয়েছে। তবুও এক জন শিক্ষককে রাস্তায় ফেলে পেটানো হচ্ছে, কিংবা ডাক্তারের গায়ে বিষ্ঠা লেপে দেওয়া হচ্ছে, এই ছবিগুলো চেতনায় একটা ছাপ ফেলে দেয়। মনে হয়, আমাদের বোধহয় বার বার বলার এবং ভেবে দেখার সময় হয়েছে, এই প্রতিশোধ কেন! যে-কোনও সভ্য সমাজের সম্পদ যে বিশ্বাস, তাকে নিঃশেষে ধ্বংস করার ফলে আমরা ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছি! জীবন তো কম্পিউটারের পরদা নয় যে, কন্ট্রোল+জেড টিপে দিলেই ঠিক আগের জায়গায় ফিরে যাব। আর যদি তা যাওয়াও যেত, আমরা কোথায় যেতাম? সাম্প্রতিক ঘটনা থেকেই উদাহরণ দিই। পর-পর কয়েকটা স্কুলে ছাত্রীর ওপর শিক্ষকের নির্যাতনের খবর পাওয়ার পর অভিভাবকদের তরফ থেকে দাবি উঠেছে, মেয়েদের স্কুলে পুরুষ শিক্ষক রাখা চলবে না। অর্থাৎ মাথাব্যথা সারাতে মাথাটাই কেটে বাদ দেওয়া ভাল! কিন্তু যে স্কুলগুলোয় সহশিক্ষা চালু আছে, তাদের কী হবে? একই যুক্তিতে অফিসে মেয়েদের হেনস্তা রোধ করতে তো অফিস যাওয়াই বন্ধ করে দিতে হয়। এ-ভাবে পিছু হটতে-হটতে আমরা কোথায় পৌঁছব? অফিসের কর্তা যদি ‘ঝামেলা এড়াতে’ মহিলা কর্মী না রাখেন, নামকরা বিজ্ঞানী যদি মেয়ে রিসার্চ স্কলার না নিতে চান, তাঁদেরই বা দোষ দেব কোন যুক্তিতে? বিশ্বাসের অভাব যদি সর্বাঙ্গীন হয়, সেটা নানা রকম ভাবেই আমাদের জীবনে দেখা দেবে। তাই হিংসাত্মক হয়ে ওঠাটা কোনও সমাধান নয়। এমন কিছু দাবি করাও উচিত নয়, যা সাম্প্রদায়িকতা বা লিঙ্গবৈষম্যকে প্রশ্রয় দেয়। কারণ সেটা আজ বা কাল অন্য অনেক সমস্যার জন্ম দেবে।

বিষয়টা কঠিন এবং সংবেদনশীল। প্রথমেই বলেছি, বিশ্বাস হারানোর মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটছে, এবং সেটা অহেতুক নয়, কিন্তু বিশ্বাস হারানোটাও যে একটা ক্ষতি, সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। আইন মানেই ফাঁক, চিকিৎসা মানেই গাফিলতি, শিক্ষক মানেই ফাঁকিবাজ, এ-ভাবে দেখলে জীবনটা শুধু যুদ্ধই হয়ে দাঁড়াবে। রবীন্দ্রনাথ এক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘জীবনটাকে না হয় যুদ্ধ বলিয়াই গণ্য করা গেল। এই যুদ্ধ ব্যাপারে যদি কেবল ব্যূহের মধ্যে প্রবেশ করিবার বিদ্যা আমাদের শেখা থাকে, ব্যূহ হইতে বাহির হইবার কৌশল আমরা না জানি, তবে সপ্তরথী মিলিয়া যে আমাদিগকে মারিবে।’ আমাদের সচেতন থাকতে হবে, কিন্তু সর্বদা সন্দিহান হলে চলবে না। শিশুকে গুড-টাচ-ব্যাড-টাচ শেখাব, কিন্তু তাকে আলাদা করে রাখব না। অর্থাৎ কোনও এক জায়গায় বিশ্বাস রাখতেই হবে।

প্রযুক্তির কল্যাণে আজ যে-কোনও তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া খুব সহজ। তাই আমাদের অনেক বিচারই শুরু হয় ফেসবুকের দেওয়াল থেকে, কিংবা সরাসরি মিডিয়ার মধ্যস্থতায়। এটা সম্পূর্ণ একতরফা একমাত্রিক এক ব্যবস্থা, যা কোনও তদন্ত ছাড়াই যে-কোনও ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে। বিপন্নতার মুহূর্তে আমরা চাই এই রকম হাতেগরম সমাধান। কিন্তু মনে রাখা দরকার, শাস্তির একটা পদ্ধতি আছে। আর তার জন্য কিছুটা সময়, কিছুটা তদন্ত দরকার হবেই। নির্যাতিত শিশুটির মা-বাবা অধৈর্য হতেই পারেন। কিন্তু যাঁরা পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের সেটা মনে রাখা দরকার। যে-কোনও সংস্থা তার কর্মীর স্বার্থ কিছুটা দেখবে, এটাই স্বাভাবিক ও উচিত। তাই দাবি করলেই বিনা তদন্তে স্কুল তার শিক্ষককে তাড়িয়ে দিল, এটা হতে পারে না।

আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করব (যেটা সচরাচর করি না)। কিন্তু কিসের প্রতিবাদ করছি, আর কী চাইছি, সেটা যেন পরিষ্কার থাকে। না হলে তার ফল আমাদের পক্ষেও ভাল হবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

protests School Revenge Punishment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE