পাকিস্তানের মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী চল্লিশ বৎসরের সাবিন মাহমুদ-কে গত শুক্রবার গুলি করিয়া হত্যা করা হইল। তিনি গাড়ি চালাইয়া ফিরিতেছিলেন, 'T2F' (দ্য স্পেস অন দ্য সেকেন্ড ফ্লোর) হইতে। ইহা সাবিন-পরিকল্পিত একটি কাফে, বইয়ের দোকান, বিভিন্ন শিল্পচর্চা ও আলোচনার স্থান। সাবিনের ভাষায়, এইটি ‘এমন এক জায়গা, যেখানে বহু ধরনের মানুষ স্বচ্ছন্দ বোধ করিবেন।’ এইখানে কবিতাও পড়া হইত, চলচ্চিত্রও দেখানো হইত, বিভিন্ন বিতর্কও হইত। করাচির সাংস্কৃতিক চালচিত্রে এইটি ছিল এক মুক্তাঞ্চল, যেখানে স্বাধীন ও বিকল্প চিন্তাধারা নিয়মিত উদযাপন করা হইত। এই দিন একটি আলোচনাসভা ছিল, তাহার বিষয় ‘বালুচিস্তান’। ‘আনসাইলেন্সিং বালুচিস্তান টেক ২’ নামে এই আলোচনায় যাঁহারা অংশ লইয়াছিলেন, তাঁহাদের লইয়াই, প্রায় একই বিষয়ে একটি সভার বন্দোবস্ত করা হইয়াছিল সপ্তাহ দুই পূর্বে, লাহৌর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস-এ, তাহা শেষ মূহূর্তে বাতিল করা হয়, সংস্থাটির প্রকাশিত বিবৃতি অনুযায়ী ‘সরকারি আদেশ অনুসারে’।
বালুচিস্তান পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ এবং সম্ভবত সর্বাধিক পিছাইয়া থাকা প্রদেশও। এই স্থানে বারংবার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হইয়াছে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এই আন্দোলন প্রশমিত করিবার প্রয়াস করিতেছে, প্রদেশটির বহু এলাকার সহিত অবশিষ্ট পাকিস্তানের সকল যোগাযোগ কর্তিত হইয়াছে। বালুচিস্তানের আন্দোলনকারীদের মতে, সরকার কর্তৃক সেই আন্দোলনকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ তকমা দিয়া, অমানবিক ভাবে দমন করা চলিতেছে। ২০০৫ সাল হইতে বহু আন্দোলনকর্মী, ছাত্র ‘অদৃশ্য’ হইয়া যাইতেছেন, তাঁহাদের কাহারও মৃতদেহ বহু দিন পরে আবিষ্কৃত হইতেছে। এই লইয়া প্রশ্ন তুলিবার জন্য ‘দ্য ভয়েস অব বালুচ মিসিং পার্সনস’ সংগঠন তৈয়ারি হইয়াছে, সেই সংস্থার দুই অগ্রণী কর্মী সাবিন-আয়োজিত আলোচনাসভায় অংশ লইয়াছিলেন। সাবিন বলিয়াছিলেন, পাকিস্তানের মূলস্রোতে তাহার বৃহত্তম প্রদেশ লইয়া আলোচনার স্বর কেন বাংরবার রুদ্ধ করিয়া দেওয়া হইতেছে? বালুচিস্তানে গণমাধ্যমকেও কি নিশ্চুপ করাইয়া রাখা হইয়াছে, ‘জাতীয় স্বার্থে’? জাতীয় স্বার্থ তবে কী?
পাকিস্তানের এক মানবাধিকার কর্মী, যিনি এখন প্রাণভয়ে আমেরিকায় বসবাস করিতেছেন, বলিয়াছেন, ‘সাবিন ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদ, সর্বোপরি যুক্তিবাদের স্বর, তাই পাকিস্তানের ‘নির্মিত’ জাতীয়তাবাদের পক্ষে বিপজ্জনক।’ কাহারও মতে ইহা পাকিস্তানের ‘ইংরাজি বলিতে স্বচ্ছন্দ বিত্তশালী বর্গের, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করিবার সাম্প্রতিক অভ্যাস’কে ভীতি প্রদর্শন। এই সভাটি লইয়া সাবিনকে যথারীতি হুমকি দেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু তিনি পিছাইয়া আসেন নাই। যে কোনও নির্ভীক ও বিরুদ্ধ-মতাবলম্বী মানুষকে খুন করো ও বিরোধী-মতের অধিকারকে পুঁতিয়া দাও— ইহা বহু দিন ধরিয়াই বহু ক্ষমতা-কেন্দ্রের প্রিয় পদ্ধতি, ইদানীং বাংলাদেশের ব্লগারকে প্রকাশ্যে কুপাইয়া খুন করিয়া, ভারতের লেখককে আন্দোলন করিয়া ভয় দেখাইয়া তাঁহাকে সকল লেখা হইতে স্বেচ্ছানির্বাসন ও ‘লেখকসত্তার আত্মহত্যা’য় প্ররোচিত করিয়া— সমগ্র পৃথিবী জুড়িয়াই সাড়ম্বরে এই পদ্ধতি পালিত হইতেছে। বিশ্ব যত ‘আধুনিক’ হইতেছে, যত সোশাল নেটওয়ার্কে অনর্গল বাক্স্বাধীনতার প্রবণতা প্রশ্রয় পাইতেছে, ততই যেন রাষ্ট্র শ্বাসরোধকারী দমননীতির, অগণতান্ত্রিকতার, অসহনশীলতার পথে হাঁটিতেছে, ইন্টারনেটের গলা টিপিয়া ধরিবার পদ্ধতি আবিষ্কারের তাড়নায় তাহার ঘুম ছুটিতেছে। প্রযুক্তিতে সম্ুখে হাঁটিব ও যুক্তিকে ক্রমাগত পিছনে ঠেলিব, ইহা বহু কর্তাবাবার মত। ভলতেয়ারের দিন তবে অবসান হইল, এই বার ‘ভুলতেয়ার’গণের দাপাইয়া বেড়াইবার পালা।
যৎকিঞ্চিৎ
ভূমিকম্পের চোটে বাংলা দিনভর থরথর! মোবাইলে চুটকি: রজনীকান্ত-এর ফোন ভাইব্রেশন মোড-এ ছিল, তাই কাঁপুনি। গুজব: আবার তিনটের সময় ভূমিকম্প হবে, নাসা বলেছে। ভারত সরকার তা লুকনোরও চেষ্টা করছে! সবাই অট্টালিকার ছবি তুলে হোয়াট্স্যাপে পাঠাচ্ছে, শ্যাওলার দাগকে বলছে ভয়াবহ ক্র্যাক। বস্তির লোকেরা লাফাচ্ছে, কী র্যা, আর সাউথ সিটিতে ফ্ল্যাট কিনবি? এর মধ্যে
পাঁচ-পাঁচটা প্রাণ চলে গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy