ধামাল: নাচে মত্ত দরবেশরা। মৌলবাদী ফতোয়া আর বিস্ফোরণের আগুন দেশজ সমন্বয়ের যে ঐতিহ্যকে এখনও ছুঁতে পারেনি। গেটি ইমেজেস
সুফি গায়কগায়িকাদের ‘ধামাল’ থামেনি। ইসলামিক স্টেট (আই এস)-এর বোমা বিস্ফোরণে লাল শাহবাজের দরগায় ৮০ জনের মৃত্যুর পরেও নয়। বিকেলের ছায়া গাঢ় না হতেই কমলা রঙের সালওয়ার কামিজ ও ওড়না গায়ে জড়িয়ে লাল শাহবাজের দরগায় ঢুকে এলেন সীমা কিরমানি। পাকিস্তানের অন্যতম সুফি গায়িকা। দরগা তখন ফেটে পড়ছে ভক্তদের ভিড়ে আর গানে। ফকির ও সুফি গায়কেরা গাইছেন: ‘তেরা সিওয়ান রহে আবাদ’।
সীমা জানালেন, সকলেই যেন তাঁর সঙ্গে এ বার ‘ধামাল’-এ নামেন। ‘ধামাল’ মানে, সাধকের উদ্দেশে ভক্তিতে প্লাবিত নাচগান। প্রথমে ধীর লয়ে শুরু হয় সেই নাচ, ক্রমে ঢাক-ঢোলের মাত্রা বাড়তে থাকে। প্রার্থনা সংগীতও যেন ক্রমে উন্মত্ত হয়ে ওঠে, দর্শকরা কেউ ‘দমাদ্দম মস্ত কালান্দার’ বলে মাটিতে গড়াগড়ি দেন, কেউ নাচের মধ্যেই কাঁদতে থাকেন। নাচতে নাচতেই যেন তাঁরা অতীন্দ্রিয় এক বোধের জগতে চলে যান।
১৬ ফেব্রুয়ারি জঙ্গি হামলার পর তখনও মাস ঘোরেনি, পাকিস্তানের রক্তস্নাত সিওয়ান শরিফের দরগায় ফের শুরু হল সুফি গানের ধামাল। ইতিহাসবেত্তারা অনেকে বলেন, ‘ধামাল’ শব্দটা এসেছে ডমরু থেকে। শিবের ডমরু।
করাচি থেকে ২৮০ কিমি রাস্তা। সিন্ধু নদে পলি পড়ে ঘোলা স্রোত, তার পাশ দিয়ে রাস্তা। মরুভূমি, ছোট পাথুরে টিলা আর কাঁটাঝোপের মাঝে হঠাৎ চোখ জুড়ানো সবুজ। সেখানে কার্পাস তুলো, আখের চাষ। কোথাও বা আমবাগান।
অঞ্চলটাকে উপমহাদেশের সুফি-রাজধানী বলা যায়। এখানেই ভিত শাহ শহরে সিন্ধি ভাষার অন্যতম কবি, সুফি সাধক শাহ আব্দুল লতিফের দরগা। লতিফ নাথযোগীদের থেকেও শিক্ষা নিয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলিম আলাদা সম্প্রদায়, এমন কখনওই ভাবেননি। তাঁর ‘রিসালো’ কাব্যসংগ্রহে লিখছেন, ‘যোগী তো অনেক। কিন্তু ভালবাসি ভস্মমাখা সাধুদের।’
এই ভিত শাহ থেকে ঘণ্টা দুয়েক গাড়িতে এগোলেই বিস্ফোরণের শিকার লাল শাহবাজ-এর দরগা। মার্কো পোলোর সমসাময়িক এই সাধক জন্মেছিলেন ইরানের তাব্রিজ শহরে। নাম ছিল শেখ উসমান মারওয়ান্দি।
কিন্তু শেখ হয়ে থাকা পোষায়নি তাঁর। মানুষকে ভালবেসে স্থানীয় হিন্দু, মুসলমান সকলের মধ্যেই তিনি অমর। মুসলমানেরা বলেন, লাল শাহবাজ এক বার নমাজ সারতে এখান থেকে মক্কায় উড়ে গিয়েছিলেন। হিন্দুরা আবার বলেন, আগের জন্মে লাল শাহবাজই ছিলেন স্বয়ং ভর্তৃহরি। দুই সম্প্রদায়ই তাঁকে নিয়ে তৈরি করেছেন নিজস্ব মিথ।
করবেন না-ই বা কেন? বন্ধুরা দেখাচ্ছিলেন, আজও পাকিস্তানের এই দরগায় যিনি ভক্তদের পানীয় জল বিতরণ করেন, তিনি হিন্দু। দরগা যিনি সাফসুতরো রাখেন, তিনিও হিন্দু। বিপদে-আপদে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকলে এখানে জড়ো হয়, লাল সুতো বেঁধে রাখে। ‘যাঁরা মারা গিয়েছেন, বুকের ভিতরে তাঁদের জন্য শোক বয়ে নিয়ে যাব, কিন্তু ঐতিহ্য থামবে না। ঘুঙুরের বোল আর ধামালকে দমিয়ে রাখা যাবে না,’ লাল শাহবাজের দরগায় নাচের মাঝেই বললেন সীমা। মানুষ ফুল, মালা ছুড়ে, করতালিতে সমর্থন করল তাঁকে।
ঢোকার আগে দরগার ভিড়েই খুঁজে পেয়েছিলাম আসগর ব্রোহিকে। আসগরের পরিবারের তিন জনই ফেব্রুয়ারি মাসে সেই বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন, আজ চোখে জল নিয়েও এসেছেন। ফিসফিস করে বললেন, ‘আবার আসব। আমাদের নিকেশ করতে পারবে না ওরা।’ আইএস ও জঙ্গি তালিবান কল্পিত ইসলামিক রাষ্ট্র সুফি সমন্বয়বাদের বয়ানে বিশ্বাস করে না বলেই কি বিস্ফোরণ?
দুই ইসলামের দ্বন্দ্বই ভিতরে ভিতরে ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছে পাকিস্তানকে। দ্বন্দ্বটা প্রথম টের পেয়েছিলাম বছর কয়েক আগে। আমার বই ‘নাইন লাইভ্স’-এ সুফি সাধকদের কথা লেখার জন্য এসেছিলাম এই লাল শাহবাজের দরগাতেই। সে দিনই ঠাহর করেছিলাম, দরগার অদূরে পুরনো এক হাভেলিতে নতুন চকচকে টাইল্স। সৌদি আরবের অর্থে তৈরি মাদ্রাসা। দরগায় সে বারই অনেকে দুঃখ করছিলেন, ‘বাপ, পিতামহের আমল থেকে আছি। এখন মাদ্রাসার ছেলেরা এসে বলে, গান গাওয়া গুণাহ্। মেয়েদের দরগায় আসা হারাম।’
২০০৯ সালে, সে বারও লাল শাহবাজের এই মসজিদে পাওয়া গিয়েছিল বিস্ফোরক। কেউ হতাহত হননি, পর দিন তালিবানরা বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, দরগায় নাচগান আর মেয়েদের ঢুকতে দিলে এই রকমই ঘটবে। সিন্ধু প্রদেশ সে বারে হার মানেনি, এ বারেও সীমা কিরমানিরা অটুট। এলাকাটা বার বার প্রমাণ করছে, ইসলামের মধ্যেই আছে বহুত্ববাদ, গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জোরালো সামর্থ্য।
কিন্তু ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির সুবিধেবাদী মিশ্রণে উল্টা বুঝিলি রাম! সৌদি আনুকূল্যের ওই নতুন মাদ্রাসার দায়িত্বে সালেমুল্লা নামে ঝকঝকে এক যুবক। মেঝেতে বসে জনা কুড়ি শিশু কোরানের আয়াৎ মুখস্থ করছে, সারা ঘরে একটিই ডেস্ক। সেটি শিক্ষকের জন্য।
সালেমুল্লা জানালেন, ‘কবরে আমরা পুজো চড়াই না। তুমি সাধক-টাধক যে হও, আল্লা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও শক্তি নেই। এই লোকগুলোকে বার বার বুঝিয়েছি, দরকারে মসজিদে যাও। কিন্তু দরগায় নয়। গানবাজনা আমাদের শরিয়তি বিধানে নেই।’
‘লোকে মেনেছে?’
‘ধুর’, সালেমুল্লার কণ্ঠে রাগ ঝরে পড়ল, ‘এগুলো সব হিন্দু প্রভাব। এখানে আগে বড়লোক হিন্দুরা থাকত, পুতুলপুজো করত। অশিক্ষিত, গরিব মানুষগুলো তাদের থেকেই এই সব বাজে জিনিস রপ্ত করেছিল। সারা পাকিস্তানে এক গল্প, কিন্তু এই এলাকাটা সবচেয়ে পিছিয়ে।’
‘কিন্তু সুফিবাদ তো এখানে প্রায় সাতশো বছরের ঐতিহ্য!’
সালেমুল্লা হেসে ফেললেন, ‘সুফিবাদ কি ইসলাম নাকি? জাদু। এখানকার গরিবগুর্বো, সংস্কারাচ্ছন্ন লোকগুলো ওই জাদুতে মজেছে।’
‘কিন্তু সুফি কেন মসজিদকে প্রাধান্য দেবে? তাঁরা তো বলেন, বেহেস্ত বা স্বর্গ আমাদের হৃদয়েই।’
‘এ সব শয়তানের খোয়াব। কোরানে কোথায় লেখা এই কথা? শুনুন, হৃদয় ছোট্ট জায়গা। আল্লা তাঁর লোকদের জন্য তাই বেহেস্ত তৈরি করেছেন।’
রক্তাক্ত সিন্ধুপ্রদেশে সালেমুল্লার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ভাবনাটা মাথায় চাড়া দিল। ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ মার্কা যে সব তত্ত্ব আজকের বাজারে চলে, ভুল। সংঘর্ষ আসলে দুই ইসলামে। সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার বছরে পাকিস্তানে ছিল ২৪৫টি মাদ্রাসা, আজ ৮ হাজারের বেশি।
এক সুফি ফকির শুনিয়েছিলেন অন্য কথা। ‘এই পাহাড়, মরুভূমি সবেতেই আল্লার চিহ্ন। মোল্লারা বরং কোরানের শিক্ষা বিকৃত করে। ছোট-বড় যে কোনও জাত, বিপথগামী মেয়ে, সকলে দরগায় আসতে পারে। মানুষের ভুলভ্রান্তিকে আমরা, সুফিরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। ভালবাসাটাই আসল।’ জিহাদের কথাও বলছিলেন তিনি, ‘ওরা তরবারি, বোমা, বন্দুকে জিহাদ ঘটাতে চায়। আমরা বলি, আসল জিহাদ হৃদয়ে। তোমার ভিতরের শয়তানকে পরাস্ত করো, সেটাই ধর্মযুদ্ধ।’
সীমার গান দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, বিস্ফোরণের পরও সুফি ইসলাম হারেনি। কিন্তু এই সংঘর্ষ আর কত দিন? পাকিস্তানকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সমন্বয়ের সুফি ইসলামকে আই এস হামলা থেকে বাঁচানো তাদেরই দায়িত্ব!
অনুলিখন: গৌতম চক্রবর্তী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy