Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

কন্যার উপার্জন

কেন মরিতেছে কাপড়কলের মেয়েরা? তামিলনাড়ুর শ্রমিক ইউনিয়ন হইতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা গবেষণা সংস্থা তাহাদের রিপোর্টে কাপড়কলে কর্মসংস্কৃতির ভয়াবহতার দিকটি তুলিয়া ধরিয়াছে।

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৮ ০০:৩২
Share: Save:

একটি বেসরকারি হাসপাতালের নার্সিং কলেজের এক ছাত্রীর অপমৃত্যু হইল। অনুমান, পরীক্ষার ফল খারাপ হইবার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের তিরস্কারে অপমানিত হইয়া তিনি আত্মহত্যা করিয়াছেন। কিন্তু এই আপাত-কারণটির পশ্চাতে বৃহত্তর সমস্যার ছায়া দেখা গিয়াছে। প্রয়াত ছাত্রীর সতীর্থদের অভিযোগ, উপস্থিতির হারে অতিরিক্ত কড়াকড়ি, অসুস্থতাতেও ছুটি না-মঞ্জুর, ব্যক্তিগত জীবন লইয়া কটূক্তি-সহ নানা মানসিক নির্যাতন, ছাত্রী-আবাসে প্রতিকূল পরিবেশ ছাত্রীদের বিপর্যস্ত করিতেছে। গত বৎসর আর এক বেসরকারি হাসপাতালে নার্সিং ছাত্রীর মৃত্যুর পর এই সকল অভিযোগই উঠিয়াছিল। অসুস্থতা সত্ত্বেও কাজ করিতে বাধ্য করা, এবং ঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা না করিবার জন্য উমার মৃত্যু হইয়াছে, এমন দাবি করিয়া তখন বিক্ষোভ দেখাইয়াছিলেন নার্সিং ছাত্রীরা। এই সকল অভিযোগ কতটা যথাযথ, তাহা অনুসন্ধানসাপেক্ষ। তবে বিবিধ কর্মক্ষেত্র হইতে যে সকল ইঙ্গিত মিলিতেছে, তাহা স্বস্তির নহে। যেমন, তামিলনাড়ুর বস্ত্রশিল্পের কারখানাগুলিতে নাকি গত তিন মাসে কুড়ি জন মহিলা-কর্মী আত্মহত্যা করিয়াছেন। গত তিন বৎসরে এমন আত্মহননকারী কিশোরী বা তরুণীর সংখ্যা অন্তত পঞ্চান্ন। হতদরিদ্র পরিবারের এই সন্তানদের অপমৃত্যু সে ভাবে দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাই। ‘বেটি বঁচাও’ রব তুলিয়াও রাষ্ট্র এই কন্যাদের প্রতি অন্ধ।

কেন মরিতেছে কাপড়কলের মেয়েরা? তামিলনাড়ুর শ্রমিক ইউনিয়ন হইতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা গবেষণা সংস্থা তাহাদের রিপোর্টে কাপড়কলে কর্মসংস্কৃতির ভয়াবহতার দিকটি তুলিয়া ধরিয়াছে। বিভিন্ন গ্রাম হইতে আগত কিশোরী ও তরুণীরা কার্যত বন্দিদশায়, ন্যূনতম বেতনে, বিশ্রামহীন ভাবে কাজ করিতে বাধ্য হন। কারখানা ও কর্মী-আবাস, উভয় তরফেই মেয়েদের উপর কড়া নজরদারি চলিতে থাকে। কাজের সময় বারো ঘণ্টাও ছুঁইতে পারে, অসুস্থ অবস্থায় কাজে বাধ্য করিবার দৃষ্টান্তও কম নাই। মেয়েদের অনুপস্থিতি নিয়ন্ত্রণের উপায় ভীতিপ্রদর্শন। কারখানার কর্মীদের ক্ষেত্রে তাহা প্রাপ্য না পাইবার ভয়। তিন বৎসর বা পাঁচ বৎসর নিয়মিত কাজ করিলে একটি বড় অঙ্কের টাকা দেওয়া হইবে, এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় মেয়েদের পরিবারকে। ওই টাকা হারাইবার ভয়ে তাঁহারা সামান্য বেতনে প্রায় দাসশ্রমিকের পরিস্থিতি সহিতে থাকেন। অন্যান্য পেশায় দেখা যায়, শিক্ষানবিশ ছাত্রীদের ফেল করাইবার, অথবা প্রশিক্ষণরত কর্মীর চাকরি পাকা না করিবার ভয় দেখাইয়া উপস্থিতি নিশ্চিত করা হইতেছে।

ভারতের পুরুষতন্ত্রের দাপট আজও প্রবল। তাই পুরুষদের যে নির্দেশ দিতে দ্বিধা করিবেন মালিক, তাহাই স্বচ্ছন্দে বলিতে পারেন অল্পবয়সি মেয়েদের। একশো শতাংশ উপস্থিতি, কাজের বাহিরেও নজরদারি, ব্যক্তিজীবনে প্রশিক্ষক-মালিকের নিরন্তর হস্তক্ষেপ, এমন সব শর্ত পুরুষেরা সহজে মানিবে না। মেয়েদের ক্ষেত্রে তাহা ‘নিয়মানুবর্তিতা’ বলিয়া প্রয়োগ করা হইতেছে। সত্য এই যে, ভারতের নিয়োগকারীরা মেয়েদের ন্যায় বা নিরাপত্তা, কোনওটিই দিতে পারে নাই। নার্সিং পরিষেবা বরাবরই মেয়েদের নিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। নার্সিং প্রশিক্ষণে অন্যায় শর্ত তৈরি হইয়াছে কি না, দেখিতে হইবে সরকারকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Patriarchy Feminism Suicide
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE