গালি নয়, গোলা নয়। ও সব ছাড়িয়া এ বার উহাদের গলায় টানিয়া লইতে হইবে। এমন একটি সূত্র দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে শুনিতে নিশ্চয়ই কাশ্মীর উপত্যকার বাসিন্দারা প্রস্তুত ছিলেন না। চন্দ্রভাগা দিয়া ইতিমধ্যে এত রক্ত বহিয়া গিয়াছে যে এমন কথা প্রত্যাশা করিবার অবস্থা তাঁহাদের নাই। কিন্তু তবু ভারতের একাত্তরতম স্বাধীনতাদিবসে তেমনই একটি বার্তা দিল্লি হইতে কাশ্মীর উপত্যকার দিকে ভাসিয়া আসিল। প্রতিটি কাশ্মীরি মানুষকে আলিঙ্গন করিয়া সমস্যা সমাধানের পথে অগ্রসর হইবার ডাক দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বাক্পটু মোদী বিলক্ষণ জানেন, কথা বস্তুটি কত গুরুতর। জানেন বলিয়াই না অধিকাংশ সংকটময় মুহূর্তে তিনি একটি বাক্যও ব্যয় না করিয়া নীরব থাকা শ্রেয় মনে করেন। কাশ্মীর বিষয়ে তাঁহার এই সাম্প্রতিক বার্তা তাই আকস্মিক ভাবিবার কারণ নাই। নিশ্চয় জানিয়া বুঝিয়াই তিনি এত বড় কথাটি বলিয়াছেন। এবং সে ক্ষেত্রে তাঁহার এই সুচিন্তিত বার্তাকে উদ্বাহু স্বাগত জানাইতেই হইবে। যে পরিস্থিতিতেই হউক, এমন একটি শুভ ভাবনার উচ্চারণকে স্বাগত না জানাইয়া উপায় নাই। কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি এবং কাশ্মীরের বিরোধী দলনেতা ওমর আবদুল্লা দুই জনই তাহাই করিয়াছেন, এবং দুই জনই আন্তরিক আশা প্রকাশ করিয়াছেন যে অতঃপর প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিতে কাশ্মীরের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাব কিছুটা হইলেও পাল্টাইবে। না আঁচাইলে বিশ্বাস নাই তাই আঁচানো হইবে ইহাই প্রত্যাশিত, ওমর আবদুল্লা উবাচ।
সমস্যা আঁচানো লইয়াই। গত দুই বৎসরে কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী দমনের নামে সেনাবাহিনীর প্রবল অত্যাচার, উগ্রপন্থীদের খুঁজিয়া বাহির করিবার নামে উপত্যকার সাধারণ মানুষের উপর মাত্রাছাড়া হানাতল্লাশি, গোলাগুলি, ইহাই তো একমাত্র কথা নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে একের পর এক উগ্র হুমকি কাশ্মীরের প্রতি বর্ষিত হইয়াছে, সেনাবাহিনীকে উপর্যুপরি কড়া পদক্ষেপের নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে, ভয় দেখানো হইয়াছে যে বিচ্ছিন্নতাবাদ না থামিলে উপত্যকার নিস্তার নাই। এত দিনের এত রকম কাজকর্ম কি প্রধানমন্ত্রীর এক দিনের বাক্যসুধায় গলিয়া নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে? তাহা কি সম্ভব? মাত্র কয়েক মাস আগে প্রধানমন্ত্রী নিজ মুখে বলিয়াছেন, কাশ্মীরের জন্য ‘স্থায়ী সমাধান’ –এর সন্ধান জরুরি। সামরিক সংকট প্রসঙ্গে কথাটি বলা হইয়াছিল, সুতরাং সামরিক প্রেক্ষিতেই ‘স্থায়ী সমাধান’ শব্দবন্ধটিকে বুঝিতে হইবে। আজ হঠাৎ কোলাকুলির ইচ্ছা প্রকাশ করিলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিবে, আগের ওই শব্দবন্ধ কিংবা ভাবনাধারার সহিত ইহার কী সম্পর্ক। প্রাক্তন মন্ত্রী পি চিদম্বরম সেই প্রশ্নই করিয়াছেন, হাতে বন্দুক লইয়াই কি কাশ্মীরিদের বুকে টানিয়া লওয়া হইবে?
প্রধানমন্ত্রীর সুবচন এমন সময়ে বর্ষিত হইল যখন উপত্যকা জুড়িয়া উদ্বেগ ও অশান্তির স্রোত বহমান। রাজ্য সরকারের শরিক বিজেপি ৩৫-এ ধারার সংশোধনের জন্য আপাতত সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ, এবং জম্মু ও ও লাদাখের মুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলিতে আশঙ্কার সহিত আতঙ্ক দ্রুত বর্ধমান। আশঙ্কা, এই প্রদেশের বিশেষ সুযোগসুবিধাগুলি এই নূতন সংশোধনের ফলে যাইতে বসিবে। আশঙ্কা অমূলক নহে। কোনও বিবাদ-বিতর্কের তোয়াক্কা না করিয়া, সংসদীয় আলোচনার তোয়াক্কা না করিয়াই যে বিজেপি ঘুরপথে কাশ্মীরের বিশেষ অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাইতে উদ্যত, উপত্যকার বাহিরের নাগরিকরাও তাহা ভালমতো খেয়াল করিতেছেন। কাশ্মীর সংকট যে দেশের পক্ষে সংকটময় হইলেও বিজেপি রাজনীতির পক্ষে সুবিধাজনক, তাহাও অনেকেই বুঝিতেছেন। এমতাবস্থায় কোলাকুলির আশ্বাস দিয়া ঠিক কোন উদ্দেশ্য সাধনের আশা করিতেছেন বিজেপি-তিলক প্রধানমন্ত্রী— ভবিষ্যৎই বলিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy