Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ভোগবাদের সঙ্গে যেখানে পুরুষতন্ত্রের সহবাস

সফল পুরুষ কাকে বলে

হিউ হেফনার কিন্তু সেই পরাভবের ঊর্ধ্বে। প্লেবয় ম্যানসনের বিপুল শয্যায় সিল্কের পাজামা পরে শুয়ে গোটা সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ, নিজের হিসেবেই এক হাজারেরও বেশি শয্যাসঙ্গিনী, ব্যক্তিগত জীবনকে যত দূর সম্ভব প্রকাশ্যে বাঁচা— নিজের জীবৎকালেই কিংবদন্তি হয়েছিলেন তিনি।

সফল: প্লেবয় মডেল-পরিবৃত হিউ হেফনার। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ১৯৯৯। ছবি: এপি

সফল: প্লেবয় মডেল-পরিবৃত হিউ হেফনার। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ১৯৯৯। ছবি: এপি

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৭ ০৬:১০
Share: Save:

হিউ হেফনার মারা গেলেন। ৯১ বছর বয়সে। জীবনের শেষ দিন অবধি যে পত্রিকার এডিটর-ইন-চিফ ছিলেন হেফ, সেই প্লেবয় অবশ্য মারা গিয়েছে আরও বেশ কয়েক বছর আগেই। এখনও প্রতি মাসেই প্রকাশিত হয় প্লেবয়, কিন্তু আজকের ইন্টারনেটের দুনিয়ায় যেখানে কল্পনাসম্ভব ও কল্পনাতীত সব রকম যৌনতার ছবি আর চলচ্চিত্রই কয়েক ক্লিকের দূরত্বে, সেখানে ম্যাগাজিনের অস্তিত্ব অকিঞ্চিৎকর। হিউ হেফনার কিন্তু সেই পরাভবের ঊর্ধ্বে। প্লেবয় ম্যানসনের বিপুল শয্যায় সিল্কের পাজামা পরে শুয়ে গোটা সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ, নিজের হিসেবেই এক হাজারেরও বেশি শয্যাসঙ্গিনী, ব্যক্তিগত জীবনকে যত দূর সম্ভব প্রকাশ্যে বাঁচা— নিজের জীবৎকালেই কিংবদন্তি হয়েছিলেন তিনি। অবশ্য, ইতিহাসের কাছে আরও খানিক বেশিই দাবি করতে পারেন হিউ হেফনার। বলতেই পারেন, গোটা দুনিয়ার ‘সফল শহুরে পুরুষ’-এর ধারণা নির্মাণ করেছেন তিনি।

১৯৫৩ সালে হেফনার প্রথম প্রকাশ করেছিলেন প্লেবয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। স্থান আর কালের মহিমা অনস্বীকার্য। মাত্র দু’দশক আগে, প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট যখন মন্দাবিধ্বস্ত দেশের জন্য তৈরি করছেন ‘নিউ ডিল’, তখন আমেরিকা পেয়েছিল সুপারম্যানকে। একা হাতে সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারার মতো অতিমানব। আর, ‘নিউ ডিল’-উত্তর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর, দুনিয়ার অপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্থিক শক্তির স্বীকৃতি পাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মেছিল প্লেবয়, সেই দেশে, গোটা দুনিয়ার চোখে যা হয়ে উঠতে চলেছিল ভোগবাদের সমার্থক।
প্লেবয়-এর জন্ম অনিশ্চয়তা-পরবর্তা সমৃদ্ধির সময়ও। টাকা দিয়ে সব কেনা যায়, এবং চেষ্টা করলে সেই টাকা অর্জন করতে পারে যে কেউ, এই দর্শনের সমসাময়িক হল প্লেবয়। ‘আমেরিকান ড্রিম’ তো এটাই।

সেই ভাল থাকার মূল কথা হল স্বাধীনতা। বিলাসী পণ্য কিনতে পারার স্বাধীনতা, নিজের ইচ্ছায় যৌনতার স্বাধীনতা, পারিবারিক বন্ধনের থেকেও স্বাধীনতা বটে। বিয়ের ঘোর বিরোধী ছিলেন হেফনার। তাঁর মত ছিল, কিছু ডলার খরচ করলেই যখন প্রতি সন্ধ্যায় পেয়ে যেতে পারেন আকর্ষক সঙ্গিনী, তখন আর বিয়ে করে স্ত্রীর খপ্পরে পড়া কেন? পঞ্চাশের দশকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই অবস্থান বিলক্ষণ বৈপ্লবিক ছিল। যৌনতা নিয়ে রাখঢাক, পরিবারের প্রশ্নাতীত গুরুত্ব, সব মিলিয়ে প্রায় ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতায় মোড়া ছিল দেশটা। অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য যা উপযুক্ত নয়, তেমন সব কিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখত সমাজ। এই সমাজের মুখের ওপর হেফনার ছুড়ে দিয়েছিলেন তাঁর ‘প্লেবয় ফিলজফি’। হ্যাঁ, মুখের কথা নয়, একেবারে ছাপার অক্ষরে বহু পর্বে প্রকাশিত হয়েছিল হেফনারের এই দর্শন।

সেই দর্শন স্বাধীনতার। বাজারের স্বাধীনতা, ক্রেতার স্বাধীনতা। যৌনতার স্বাধীনতা। বর্ণবিদ্বেষের বিরোধী ছিল প্লেবয় ফিলজফি। সমকামিতার পক্ষে। রাষ্ট্রের ওপর চার্চের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে। ভেবে দেখলে, ষাটের দশকের উদারবাদী রাজনীতির নির্যাস ছিল প্লেবয়ের দর্শনে। রাষ্ট্র, সমাজ, প্রথার যাবতীয় নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে ব্যক্তির চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা, এবং সেই চাহিদার নৈতিকতা বিচার না করার কথা বলেছিলেন হেফনার। আমি যা চাই, আমার চাওয়ার কারণেই সেই চাহিদা বৈধ, এবং সামর্থ্য থাকলে আমি তার সবটুকুই কিনে নিতে পারি— ভোগবাদের এই মূল কথাটার সঙ্গে হেফনারের দর্শন অবিচ্ছেদ্য। হেফনারের কৃতিত্ব, তিনি যৌনতাকেও পণ্যের তালিকায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। যে যৌন বিপ্লবের স্বপ্ন তিনি দেখতেন, সেটা আসলে এই ভোগবাদেরই গল্প। যেমন চাই, তেমন যৌনতা কিনে ফেলতে পারার ক্ষমতা অর্জনের গল্প।

নিয়তির পরিহাস, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঠিক তিন সপ্তাহের ব্যবধানে মারা গেলেন কেট মিলেট আর হিউ হেফনার। যৌন বিপ্লবের দুই প্রবক্তা, আর সম্পূর্ণ বিপরীত দুই মেরুর বাসিন্দা। নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রধানতম মুখ কেট মিলেটেরও মত ছিল, পরিবারের কাঠামো না ভাঙলে যৌন বিপ্লব আসবে না। হেফনারেরও মত সে রকমই। শুধু ফারাক হল, মিলেটের কাছে পরিবারের কাঠামো ভাঙার কারণ ছিল পিতৃতন্ত্রের নিগড় থেকে মেয়েদের যৌন চাহিদার স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা, আর হেফনারের কারণ ছিল যাবতীয় দায়দায়িত্ব থেকে সক্ষম পুরুষকে নিষ্কৃতি দেওয়া। তাঁর দর্শনে যৌন স্বাধীনতা বস্তুটিতে পুরুষের একান্ত অধিকার। তবে, সব পুরুষের নয়। যে পুরুষ সেই স্বাধীনতা কেনার মতো সমৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছেন, শুধু তাঁর। হেফনারের যৌন বিপ্লবের সঙ্গে তাই পুরুষতন্ত্রের কোনও ঝগড়া নেই। মুক্ত বাজার, ভোগবাদ আর পুরুষতন্ত্র দিব্যি মিলেমিশে থাকতে পারে তাঁর দর্শনে।

ষাট আর সত্তরের দশকে নারীবাদীরা কম আক্রমণ করেননি হেফনার আর তাঁর প্লেবয়কে। সেই আক্রমণ প্রায় ষোলো আনা খাঁটি। কিন্তু তার চেয়েও বড় খাঁটি কথা হল, লড়াইটা শেষমেশ হেফনারই জিতেছেন। তাঁর ম্যাগাজিন মৃত, কিন্তু দর্শনটি বিলক্ষণ জীবিত। যৌনতা যে নিতান্তই পণ্য, এবং যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতে পারলে নারীতে অনন্ত অধিকার, সভ্য সমাজ এই কথাটি নির্বিবাদে মেনে নিয়েছে। অবশ্য, একটু পাল্টেও নিয়েছে। হেফনারের জেহাদ ছিল আমেরিকার অনন্ত-কৈশোরের বিরুদ্ধে। বলতেন, দেশটার সাবালক হওয়া দরকার। আর, সেই সাবালকত্ব আসবে যৌনতার পথ ধরেই। যৌনতা এসেছে, সাবালকত্ব আসেনি। হেফনার নিজেই আসতে দেননি। শুধু পুরুষের যৌন স্বাধীনতার পতাকা ওড়াতে গিয়ে তিনি শেষ অবধি আটকে গিয়েছেন সেই অনন্ত কৈশোরেই। যেখানে, যৌনতা মানে শুধু কৈশোরের ফ্যন্টাসি— সেই ফ্যান্টাসিতে মেয়েরা ভোগ্যপণ্যমাত্র, তাদের যৌনতার, যৌন চাহিদার কোনও প্রকাশ নেই।

ভোগবাদের গোটা বিশ্ব সেই ধারণাটাকেই আপন করে নিয়েছে। বিপণনের জগৎ বলবে, সুন্দরী নারী বক্ষলগ্না হলে তবেই পুরুষ সফল। সে বিজ্ঞাপন আশির দশকের সিগারেটেরই হোক অথবা একবিংশ শতকের সুগন্ধীর, বার্গারের হোক বা ডিজাইনার পোশাকের, গাড়ির হোক বা বিয়ারের, বিজ্ঞাপনে পুরুষের সাফল্য দেখানোর সহজতম পথ হয়েছে স্বল্পবসনা নারীকে সেই পুরুষটির সম্পত্তি হিসেবে দেখিয়ে দেওয়া। সহজ হিসেব: গোটা দুনিয়ায় ক্রয়ক্ষমতা পুরুষেরই আছে, কাজেই বিজ্ঞাপনে জিততে হবে তাদেরই মন। পেজ থ্রি খুঁজে নিয়েছে ‘ট্রফি ওয়াইফ’-এর ধারণা— সফল পুরুষের সুন্দরী বউ, পুরুষের স্টেটাস সিম্বল। বিজয় মাল্য তাঁর ক্যালেন্ডার-সুন্দরীদের কোমর জড়িয়ে ছবি তুলেছেন, ইন্টারনেটে অসংখ্য সাইট খেলোয়াড়দের ‘সুপার হট ওয়্যাগ’-এর ছবি সাজিয়েছে। ওয়্যাগ হল ‘ওয়াইভস অ্যান্ড গার্লফ্রেন্ডস’: সফল খেলোয়াড়ের সাফল্যের সার্টিফিকেট।

তাঁর প্লেবয় ম্যানসনের বিপুল বিছানায় শুয়ে হিউ হেফনার নিশ্চয়ই মুচকি হাসতেন। যে ‘উইমেন লিবার’-দের বিরুদ্ধে (সত্তরের দশকে নারীবাদীরা এই নামেই পরিচিত ছিলেন) তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, সেই যুদ্ধে এর চেয়ে স্পষ্ট ফলাফল আর হয় না। তিনি জেনে গিয়েছিলেন, গোটা দুনিয়ার পুরুষ আসলে হিউ হেফনার হতে চায়— সুন্দরী, যৌবনবতী এক বা অনেক নারীর প্রভু।

ভোগবাদ আর পুরুষতন্ত্র যার বিছানায় নির্বিবাদে রাত কাটায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hugh Hefner Playboy Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE