Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

আজ কিন্তু বিশ্ব কবিতা দিবস

কবিতা আবার কোন কাজে লাগে? কবিতার কোনও সেনসেক্স হয় না, কবিতার কোনও বাজার নেই। কবিতা কি এক ইঞ্চিও উপকার করতে পেরেছে মানুষের? জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ

সুবোধ সরকার
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

কবিতা আবার কোন কাজে লাগে? কবিতার কোনও সেনসেক্স হয় না, কবিতার কোনও বাজার নেই। কবিতা কি এক ইঞ্চিও উপকার করতে পেরেছে মানুষের? জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ— এই তিনটি সময়ে তিনটি ল্যাটিন শ্লোক আর তিনটি সংস্কৃত পদ্য প্রয়োজন পড়ে বটে, তবে তার জন্য একটা বিশ্ব-কবিতা দিবস? ‘ইউনেস্কো’ যখন প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন এ ভাবেই প্রশ্ন উঠে এসেছিল কবিতার বিরুদ্ধে। আড়াই হাজার বছর আগে আরও মারাত্মক কথা উঠেছিল, কবিদের নির্বাসন দেওয়া হোক। যে প্রাচীন গ্রিসে কথাটা উঠেছিল, সেই গ্রিসই ছিল ইউরোপীয় কবিতার তলপেট।

একটা পেসমেকার যেমন কাজে লাগে, একটা হুইলচেয়ার যেমন কাজে লাগে, কবিতা কি তেমন কোনও কাজে লাগে? কবিতা লিখে তো কবিরা কিছুই পান না। টাকা নেই, পয়সা নেই, মান নেই, মর্যাদা নেই। এক ভাঁড় চা আর গলায় একটা ন্যাতা ছাড়া কবিদের কপালে কিছুই জোটে না। কবি-খ্যাতি? সে-ও তো আজ আছে, কাল নেই। তা হলে পৃথিবী জুড়ে পাঁচ শতাধিক ভাষায় কেন প্রতি দিন লেখা হয়ে চলেছে কবিতা? কবিতাই কি মনুষ্য প্রজাতির আদিমতম ও আধুনিকতম শিল্প যা মুদ্রাকে, টাকাকে, ক্যাপিটালকে তাচ্ছিল্য করে এল নিঃশব্দের তর্জনি দিয়ে?

আলাবামায় পিটার বললেন— গত দশ বছর আগে আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম কালো মানুষের সুবিচার চেয়ে। তার পিছনে ছিল একটি কবিতা, মায়া এঞ্জেলু-র ‘হোয়াই দ্য কেজেড বার্ড সিঙ্গস।’ সান্তিয়াগোর রাস্তায় যেমন এক দিন পাবলো নেরুদার কবিতা শুনে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল, ধর্মতলার মোড়ে যেমন সুভাষ মুখোপাধ্যায় শুনে পদাতিক হয়েছিল, তেমনই ‘বিদ্রোহী’ শুনে রক্ত গরম হয়নি এ রকম কোনও বাঙালি ছিল না পরাধীন ভারতে। চারশো বছর আগে শূদ্র কবি তুকারামকে খুন করেছিল মরাঠি ব্রাহ্মণেরা। তাঁর কবিতা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পাণ্ডুলিপি জলে ফেলে দিলেই কি কবিতা ডুবে যায়? সারা ভারতে যে গরিব মানুষ, দলিত মানুষ উঠে এসেছেন, তার পিছনে কি তুকারামের কবিতা নেই? হার্লেম রেনেসাঁসের সময় কি ল্যাংস্টন হিউজের কবিতা আগুন দেয়নি?

জীবনানন্দ দাশ (ছবিতে) লিখেছিলেন ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন।’ তখন পৃথিবী জুড়ে দার্শনিক থিয়োডর অ্যাডোর্নোর কথা হেডলাইন হয়ে উঠে এসেছিল। ‘আউশভিৎস-এর পর আর কবিতা লেখা সম্ভব নয়।’ গত ৬৮ বছরে কথাটি প্রায় সমস্ত কবি উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু কবিতা লেখা আরও পাঁচগুণ বেড়েছে। এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অসুখের নাম ‘জেনোফোবিয়া’। তুমি কি আমার মতো দেখতে? তুমি কি আমার মতো কথা বলো? তুমি কি আমার মতো করে ধর্মাচরণ করো? উত্তর ‘না’ হলে আমি তোমাকে ঘৃণা করব। এই অসুখ আটলান্টিক টপকে ইউরোপ হয়ে ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বা উলটোটা।

মাহমুদ দারউইশ প্যালেস্টাইনের কবি। তিনি ইজরায়েলে ঢুকতে পারতেন না। পৃথিবীর সবচেয়ে বিষণ্ণ হাইফেনের নাম প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল। তিনি সেই হাইফেন মাথা দিয়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেয়ে লিখলেন সেই কবিতা, ‘আমি এক জন আরব, আমার কার্ড নম্বর ৫০০০০, আমার চুল চারকোল, চোখ ব্রাউন, আমার আটটা ছেলেমেয়ে।’ তারপরই লিখলেন, ‘অলিভ গাছ যদি জানত তাকে কারা বড় করেছে, তা হলে অলিভ থেকে তেল বেরত না। বেরিয়ে আসত চোখের জল।’ ইজরায়েল অধিকৃত প্যালেস্টাইনের লেখক ওডেহর কাছে শুনেছি, এই কবিতা কত মানুষকে কথা বলতে শিখিয়েছে। আমরা তো বেশির ভাগ সময়ই কথা বলতে পারিনি। কবিতা তা হলে ভয়কে অতিক্রম করতে পারে? আতঙ্কের কাঁধে বসে কৌতুক করতে পারে ‘ইউএসএ/ হোয়্যার/ দ্য লিবার্টি ইজ আ স্ট্যাচু।’

বেঙ্গালুরু থেকে মাত্র একশো কিলোমিটার দূরে এক জন লেখককে বাড়ি ঢুকে গুলি করে গেল ওরা। বিচার হল কই? হল না বলেই তো আবার সেই কর্নাটকে অসহিষ্ণুতা রাস্তায় নেমে এল গত সপ্তাহে। লেখক যোগেশ নাকি ‘ভগবান গণেশ’কে খারাপ ভাবে দেখিয়েছেন, তাই তাঁর মুখে কালি দিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে চলে গেল সাত জন বাইক আরোহী।

কবিতা ফ্যাসিজমের সামনে উঠে দাঁড়িয়েছে বার বার। কিন্তু কবিতার ক’টা মাথা? দারউইশ বলছেন, কবিরা ভেবেছিলেন, কবিতা লিখে সমাজ পালটে দেবেন। দূর বোকা ছেলের দল। কবিতা লিখে কাউকে পালটানো যায় না। শুধু চোখের কোনায় একটা অশ্রুবিন্দুর অর্ধেক বেরিয়ে আসে। আর অর্ধেক থেকে যায়— দুই অর্ধেক নিয়ে মানবজাতির কবিতা। পাঁচ হাজার বছরের দুর্যোগ তাকে বিনাশ করতে পারেনি, জেনোফোবিয়া থেকে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, তখনও এক জন উইলফ্রেড আওয়েন বুকপকেটে ‘গীতাঞ্জলি’ নিয়ে যুদ্ধবিমানে উঠবেন।

সুন্দরবনের কালো মেয়েটি, কালচিনি চা বাগানের রোগা ছেলেটি যদি একটা কবিতা পড়ে উঠে দাঁড়ায়, তা হলেই কবিতা আরও পাঁচ হাজার বছর বাঁচবে। এখনও একটা কবিতা পেসমেকার, এখনও একটা কবিতা হুইলচেয়ার, এখনও একটা কবিতা আগ্নেয়গিরির ওপর বসে থাকা প্রজাপতি, এখনও একটা কবিতা হলুদ লাগা মায়ের আঁচল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE