Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

পুলিশকে ‘শাসন’ করাটাও কিন্তু রাজধর্ম পালনের শর্ত

সিপিএম মার খেয়ে প্রমাণ করল, তারা এখনও ফুরিয়ে যায়নি! দীর্ঘদিন আগেই এই নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছিল তারা। প্রস্তুতিও চলছিল। তবু প্রশ্ন একটা ছিলই। তাদের ডাকে কতটা সাড়া মিলবে?

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৭ ০০:০৮
Share: Save:

সিপিএম মার খেয়ে প্রমাণ করল, তারা এখনও ফুরিয়ে যায়নি!

দীর্ঘদিন আগেই এই নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছিল তারা। প্রস্তুতিও চলছিল। তবু প্রশ্ন একটা ছিলই। তাদের ডাকে কতটা সাড়া মিলবে? ভোটের মেশিনে যাদের অস্তিত্ব বিপন্ন বললেও কম বলা হয়, তারা এই প্রখর রোদে ‘নবান্ন চলো’ বললে কত লোক ডাকে পা মেলাবে? সোমবার এটুকু অন্তত পরিষ্কার, পুলিশকে তারা দিকে দিকে খণ্ডযুদ্ধে জড়াতে পেরেছে।

সরকারের সদর দফতরে অভিযান করা সব আমলেই বিরোধীদের পরিচিত আন্দোলন। বাম আমলে কংগ্রেস এবং পরবর্তী কালে তৃণমূল বহু বার এই রকম কর্মসূচি নিয়েছে। রাজ্য রাজনীতিতে ২১ জুলাই তারিখটি তো ইতিহাস তৈরি করেছে মহাকরণ অভিযান কেন্দ্র করেই। ১৯৯৩-এর ওই দিনটিতে যুব-কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা অভিযানে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় ১৩ জনের। গুরুতর আহত হন মমতা নিজেও। তৃণমূল কংগ্রেস তৈরির পরে আজও তাঁর দলের বাৎসরিক কর্মসূচিতে ২১ জুলাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

সৌভাগ্য, সোমবারের নবান্ন অভিযানে কোনও প্রাণহানি হয়নি। নবান্নের ওপরতলা থেকে পুলিশের কাছে এই ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ ছিল। বলে দেওয়া হয়েছিল, পরিস্থিতি মোকাবিলায় এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে গুলি চালাতে না হয়। তাই ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা, ইটবৃষ্টি ইত্যাদি ঠেকাতে লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান চললেও গুলি চলেনি। সংঘর্ষে বিক্ষোভকারীরা যেমন রক্তাক্ত হয়েছেন, তেমনই আহত হয়েছে পুলিশও। অতীতে এই ধরনের আন্দোলন দমনে অবশ্য গুলি চালাতেই বেশি অভ্যস্ত ছিল পুলিশ। ২১ জুলাই ছাড়াও আশির দশকে এসপ্ল্যানেড ইস্টে কংগ্রেসের ‘বাংলা বাঁচাও’ অভিযানে পুলিশের গুলিতে প্রাণ যায় তিন জনের। এ রকম উদাহরণ আরও আছে।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা পথে আন্দোলন করে উঠে এসেছেন। পুলিশের চোখ এড়িয়ে, প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে কী ভাবে নিজের ‘লক্ষ্য’ হাসিল করতে হয়, বিরোধী নেত্রী হিসাবে তিনি বার বার তা দেখিয়েছেন। সিপিএম-এর কিছু নেতা ও বিধায়ক পুলিশের ঘেরাটোপের ফাঁক গলে নবান্নের গেটের কাছে চলে যেতে পেরেছিলেন কী করে, সেই সব কৌশলও তাঁর না-বোঝার কথা নয়। যদিও সেখানে দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্তাকে নাকি শো-কজ করেছে প্রশাসন। কিন্তু বিস্ময় জাগে, যখন সিপিএমের এক বিধায়ক প্রশ্ন তোলেন, জনপ্রতিনিধি হিসাবে তাঁদের নবান্নে ঢুকতে দেওয়া হবে না কেন? মমতাকে যে দিন চুলের মুঠি ধরে পুলিশ মহাকরণ থেকে বার করে দিয়েছিল, সে দিন তিনিও কিন্তু সাংসদ ছিলেন।

এ যদি হয় মুদ্রার একটি দিক, সোমবারের নবান্ন অভিযানের আরও একটি দিক সকলের চোখের সামনে পরিষ্কার। তা হল, পুলিশের মারমুখী ভূমিকা। যার শিকার কর্তব্যরত সাংবাদিকরা। সিপিএম যদি মার খেয়ে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করে থাকে, তা হলে পুলিশও ওই দিন সাংবাদিকদের মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছে, তারাই সর্বশক্তিমান, ‘জগৎটাকে’ তারাই নাচাতে পারে! ঠিক কোন পরিস্থিতিতে সাংবাদিকরা পুলিশের লাঠি-ঘুঁষি-লাথি-গুঁতো খেতে খেতে রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েছেন, ন্যক্কারজনক আক্রমণে (অশালীন ভাষাসহ) মহিলা সাংবাদিকদের সম্ভ্রম ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, সেই সব প্রশ্নে সরকারপক্ষ বা শাসকদের ভিন্ন মত থাকবেই। তাতে বাস্তব ছবিটা তো বদলায় না। কোনও সাংবাদিক বা প্রচারমাধ্যমের গায়ে রাজনৈতিক রং লাগানো যেতেই পারে। তার অর্থ এই নয় যে, তিনি কাজ করতে গিয়ে অযথা পুলিশের হামলার লক্ষ্য হবেন! আর যাঁরা সে দিন পুলিশের মার খেয়েছেন, তাঁদের অনেকেই সাংবাদিক হিসাবে পরিচিত মুখ এবং বিভিন্ন নামী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

যত দূর জেনেছি, সাংবাদিক পেটানোর ঘটনা ঘটার আগেই সিপিএমের মূল রাজনৈতিক কর্মসূচি শেষ হয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও পুলিশের কয়েক জন কর্তা (যাঁদের এক জন মহিলা) বাহিনী নিয়ে এসে প্রেস ক্লাবের অদূরে রিপোর্টার-ফটোগ্রাফারদের জটলার ওপর চড়াও হলেন কেন? সাংবাদিকরা কি পুলিশকে আক্রমণ করেছিলেন? তাঁরা কি সিপিএমের বিক্ষোভকারীদের মতো পুলিশের দিকে ইট ছুড়েছিলেন? পুলিশকে রাস্তায় ফেলে বাঁশপেটা করেছিলেন? শাল-বল্লার খুঁটি তুলে এনে ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন? যদি তা না হয়, তবে পুলিশের নিন্দা করা কর্তব্য। প্রশাসনকেও তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে হবে। ভেবে দেখতে হবে, পুলিশেরই একাংশ প্রশাসনের মুখ পোড়ানোর খেলা খেলছে কি না। কারণ, পুলিশের এই আচরণ মেনে নিলে সর্ব স্তরেই ভুল বার্তা পৌঁছতে বাধ্য।

না, সাংবাদিক পেটানোর জন্য পুলিশকে আগাম ‘নির্দেশ’ দেওয়া হয়েছিল, এটা কেউ বলবে না। কিন্তু বাঁদরের হাতে খোলা তরোয়াল দিলে যা হতে পারে, উর্দিধারী লাঠিয়ালেরা যে প্রায় তেমন আচরণ করেছে, সেটা না বললে সত্যের অপলাপ হবে। বস্তুত পুলিশের একাংশের মধ্যে ইদানীং সাংবাদিক পেটানোর একটা ‘কালচার’ চালু হয়েছে। দিন কয়েক আগেও পার্ক স্ট্রিটে একটি অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে পুলিশের মার খেয়ে ফিরতে হয়েছে সাংবাদিকদের। সল্টলেকে গত পুর-নির্বাচনে পুলিশকে সাক্ষী রেখে সাংবাদিকদের ফেলে মারার স্মৃতি এখনও টাটকা। পেশাগত ঝুঁকি সাংবাদিকতায় আছে ঠিকই। সাংবাদিকরা অনেক সময় গোলমালের মধ্যে পড়ে হেনস্তার শিকার হন। কিন্তু তার সঙ্গে ‘রাজনৈতিক মস্তানি’ এবং সংগঠিত আক্রমণ শানানো হলে অবস্থা ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়ায়। যুগে যুগে দলমত নির্বিশেষে ক্ষমতাধরেরা সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়ে আসছেন, কখনও নিজেদের কুকর্ম আড়াল করতে, কখনও সমালোচনার ঝাল মেটাতে, কখনও বা ভয় পাইয়ে মুখ বন্ধ করে দেওয়ার অভিপ্রায়ে। আর এর প্রতিবাদ করলে বা অপ্রিয় সত্য বলে ফেললে অতি বড় বন্ধুও বিগড়ে যান! গণতন্ত্রের এ এক আজব রসায়ন।

সোমবারের ঘটনাও এর চেয়ে আলাদা কিছু হতে পারে না। তাই অস্বস্তি থেকেই যায়। সরকারের তরফে বিধানসভায় ‘দুঃখপ্রকাশ’ এবং সাংবাদিক প্রতিনিধিদলকে পুলিশ কমিশনারের ঘরে ডেকে আশ্বাসবাক্য শোনানোই কি যথেষ্ট? অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের এক জনকেও প্রকাশ্যে ভর্ৎসনা করা হয়নি। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাঁদের কাউকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা হয়নি। সাংবাদিক পেটানোর ‘কৃতিত্বে’ মহীয়ানরা যথারীতি লালবাজার আলো করে বসে। এতে উর্দির গর্ব বাড়ে কি না, জানা নেই। তবে প্রশাসন লোকচক্ষে কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যায়। বিষয়টা ব্যক্তিনির্ভর নয়, রাজধর্ম-নির্ভর। প্রশাসনিক কর্ণধারদের তা বুঝতে হবে। বিশ্বাসের ফাটল দ্রুত ভরাট করা সকলের পক্ষেই মঙ্গলের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Police Rule Journalists
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE