সমাবেশ মঞ্চে মুকুল রায়।
অধোগতির আঁচটা আরও এক বার পাওয়া গেল। বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি যে বেশ কিছু বছর ধরেই নিম্নগামী, অদ্ভুত এক রাজনৈতিক শূন্যতা যে ভবিষ্যৎ চিত্রপটে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, সে বিষয়ে দ্বিমত কমই। কিন্তু কখনও কখনও সেই অপসংস্কৃতি আর সারগর্ভহীনতা এত নির্লজ্জ ভাবে প্রকট হয়ে ওঠে যে, ফের মুখ না খুলে পারা যায় না।
মুকুল রায় বিজেপি দফতরে বসে বন্ধ ফাইল দেখিয়েছিলেন। ধর্মতলার সমাবেশে সেই ফাইল তিনি খুললেন। ফাইল দেখানোর রাজনীতি এ বঙ্গে আদ্যন্ত আনকোরা নয়। বাম জমানার অবসানের আগে তদানীন্তন বিরোধী নেত্রীও ফাইলের স্তূপ দেখিয়েছিলেন। ফিতের ফাঁস খুললেই বামেদের জন্য প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাবে বলে দাবি করেছিলেন। সময় মতো সেই ফিতে খুলে যাবে বলেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু রাজ্যের ক্ষমতার অলিন্দে রদবদল হতেই সে সব নিয়ে উচ্চবাচ্য হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে যেন। তৃণমূলের বিরুদ্ধেই এখন পাল্টা ফাইল আসরে হাজির হয়ে গিয়েছে বরং।
এ বারের ফাইল অবশ্য বন্ধ রয়ে গেল না। মুকুল রায় ধর্মতলার সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে ফাইল উন্মুক্ত করলেন। শাসক দল, সরকার এবং সরকার-প্রধানের ভ্রাতুষ্পুত্র তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জড়িয়ে কিছু অভিযোগ তুললেন। ফাইলেই শুধু সীমাবদ্ধ রইলেন না মুকুল রায়। তৃণমূলের বিরুদ্ধে এবং তৃণমূলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দলতন্ত্র, অপশাসন, প্রশাসনিক অপদার্থতা ও দুর্নীতি-সহ একরাশ অভিযোগ তুললেন। যে সব অভিযোগ মুকুল রায় তুলছেন আজ তৃণমূলের বিরুদ্ধে, সে সব তো নতুন নয় একেবারেই। এত দিন তা হলে নিশ্চুপ ছিলেন কেন মুকুল রায়? এত দিন কেন প্রতিবাদে সরব হননি? এ সব প্রশ্নের কোনও না কোনও উত্তর হয়তো মুকুল রায় দেবেন, কিন্তু সে সব উত্তরকে সদুত্তর আখ্যা দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় বিস্তর।
মুকুল রায়ের অভিযোগের জবাব দিতে তৃণমূলের তরফে সামনে আনা হল পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। তিনি দাবি করলেন— মুকুল রায়দের গভীরতা বরাবরই কম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢেকে রাখতেন সে সব। ঠিকই বললেন পার্থবাবু— গভীরতা কম না হলে আরও মজবুত যুক্তি সঙ্গী করেই নিজের পূর্বতন দলকে আক্রমণে নামতেন মুকুল রায়। কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায়ই বা গভীরতার পরিচয় দিলেন কোথায়? কখনও অভিযোগ করলেন, বিশ্বাসঘাতকতার। কখনও দাবি করলেন, জনপ্রতিনিধি কেনাবেচা করতেন মুকুল রায়। কখনও কটাক্ষে জানালেন, সব কিছু খেয়ে-দেয়ে এখন হাত মুছে মুকুল রায় অন্য দলে সামিল হয়েছেন। এত অনৈতিক কার্যকলাপ যে মুকুল রায় এত দিন ধরে করছিলেন, তৃণমূল নেতৃত্ব কি তা জানতেন না? নাকি জেনেও প্রশ্রয় দিচ্ছিলেন? মুকুল দল না ছাড়লে এ সব বিষয় নিয়ে তৃণমূল কি আদৌ মুখ খুলত? এতগুলো প্রশ্ন উঠে গেল। হলফ করে বলা যায় এ সব প্রশ্নের সদুত্তর তৃণমূল নেতৃত্ব দিতে পারবেন না।
মুকুল রায় বিজেপির সভামঞ্চ থেকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যা কিছু বললেন, তার মধ্যে রাজনৈতিক বক্তব্য বা রাজনৈতিক বার্তা প্রায় নেই বললেই চলে। ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং নিন্দাতেই মূলত সীমাবদ্ধ রইলেন মুকুল। জবাব দিতে গিয়ে একই পথ নিল তৃণমূলও। মুকুল রায়কে ব্যক্তিগত স্তরে আক্রমণ করাই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠল। যে ভাষায় পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন গালমন্দ করলেন নিজের প্রাক্তন রাজনৈতিক সহকর্মীকে, সেই ভাষা নিঃসন্দেহে অসংসদীয়। রাজনৈতিক ভাবে দেউলিয়া না হলে এত অগভীর বিষয়ে এবং এত অগভীর ভাষায় কেউ কাউকে আক্রমণ করতে পারেন না।
শুধু পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সাংবাদিক বৈঠকেই কিন্তু সীমাবদ্ধ থাকল না তৃণমূলের আক্রমণ। রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবকে দিয়েও মুকুল রায়ের অভিযোগ খণ্ডন করানোর চেষ্টা হল। সে চেষ্টাও খুব দুর্বল ভাবেই হল। স্বরাষ্ট্রসচিব দাবি করলেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। তবে মুকুল রায় যে রকম ভাবে ‘নথি’ দেখিয়ে আক্রমণে নামলেন, স্বরাষ্ট্রসচিব তার পাল্টা কোনও নথি দেখাতে পারলেন না। অগভীরতার ছাপ স্পষ্ট সেখানেও।
তেভাগা, নকশালবাড়ি ছুঁয়ে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম— এত বড় বড় আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে এ বাংলার রাজনীতি। স্বাভাবিক ভাবেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি, বোধবুদ্ধি, ভাষা এবং গভীরতায় এ রাজ্যের রাজনীতিকরা অন্য অনেক রাজ্যের রাজনীতিকদের চেয়ে এগিয়ে থাকবেন, এমনটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণের কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এত বড় বড় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাক্ষী যে রাজ্যের রাজনীতি, সেই রাজ্যেই রাজনীতিকদের ভাষায় এবং চিন্তা-ভাবনার গতিবিধিতে যে দৈন্য প্রকাশ পেল, তাকে বাস্তব বলে মেনে নিতে বেশ কষ্টই হয়। কিন্তু বাংলার রাজনৈতিক বাস্তবতাটা আজ এই রকমই। মেনে নিতে কষ্ট হলেও স্বীকার করতেই হচ্ছে রাজনৈতিক দীনতায় আজ সাংঘাতিক ভাবে আক্রান্ত এ রাজ্যের রাজনীতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy