Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

কী ভাষায়

মুখ্যমন্ত্রীর কথা অনুব্রত মণ্ডল বা তাঁহার সতীর্থরা সর্বদা মানিয়া চলিবেন এমন ভরসা কম। মানিয়া চলিবার জন্য শিক্ষা ও সংযম আবশ্যক।

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:১৯
Share: Save:

নোম চমস্কির মতো ভাষাবিজ্ঞানীরা বলিয়া থাকেন, মানবভাষা সৃষ্টিক্ষম। মানুষের ভাষায় অনন্ত বাক্যরাজি সৃষ্টি করা যায়, একই কথা অসংখ্য ভাবে বলা চলে, আবার ভিন্ন ভাবে বলিতে গিয়া একই কথা এক থাকে না, তাহার অর্থ ও ব্যঞ্জনার প্রতিসরণ ঘটে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি এই কথা আর এক ভাবে স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। মুখ্যমন্ত্রী চমস্কি পড়িয়াছেন কি না, তাহা লইয়া চিন্তিত হইবার প্রয়োজন নাই। তাঁহার কথাগুলি কাণ্ডজ্ঞানপ্রসূত, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাপ্রসূত। তিনি বীরভূমের দলীয় নায়ক অনুব্রত মণ্ডলকে ‘লাস্ট বারের মতো’ সতর্ক করিয়াছেন, তিনি যেন ভাষার সংযম না হারান। অনুব্রত মণ্ডলকে কেন বিশেষ করিয়া এই বাণী শুনাইতে হইয়াছে, তাহা এই রাজ্যে কাহারও অজানা নাই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সেখানে থামেন নাই।
তিনি ঘোষণা করিয়াছেন, তাঁহার বা তাঁহার সহকর্মীদের গালিগালাজ করিবার প্রয়োজন নাই, কারণ ‘আমার কাছে অনেক ভাষা, আমি সেই ভাষায় কথা বলিব’। এই অনেক ভাষা গণতন্ত্রেরও মূলমন্ত্র। স্বৈরাচারী শাসক এক ভাষাতেই সবাইকে নিয়ন্ত্রিত করিতে তৎপর। গণতন্ত্র মত ও ভাষার বিভিন্নতা রোধ করে না। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, হয়তো তাঁহার অজ্ঞাতসারেই, সেই আদর্শও সম্মানিত।

মুখ্যমন্ত্রীর কথা অনুব্রত মণ্ডল বা তাঁহার সতীর্থরা সর্বদা মানিয়া চলিবেন এমন ভরসা কম। মানিয়া চলিবার জন্য শিক্ষা ও সংযম আবশ্যক। ভারতীয় গণতন্ত্রের নায়কনায়িকারা অনেকেই, হয়তো বা অধিকাংশই, সেই শিক্ষা ও সংযম হইতে বিচ্যুত। রাজনীতির ভাষা মোটের উপর এখন একপ্রকার। অতীতবিলাসীদের মনে করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন, পুরাতন ভারতেও রাজনীতির ভাষার এই মারমুখী দিকটি মাঝে মধ্যে আত্মপ্রকাশ করিত। দুর্যোধন, দুঃশাসন, জরাসন্ধ, কর্ণ, ভীম— এই মারমুখী ভাষার প্রয়োগে অভ্যস্ত ছিলেন। অন্য নজিরও ছিল বইকি। যুধিষ্ঠির, বিদুর, ভীষ্ম— ভাষায় রাজনীতির বিচক্ষণতার পক্ষপাতী। আধুনিক কালে ইংরেজ আমলেই ভারতীয় জননায়কদের নব্য রাজনীতিতে হাতে খড়ি। তাঁহারা সে সময় রাজনীতির নানা বিশেষ ভাষা রপ্ত করিতে তৎপর। যেমন, রাজনীতির ভাষা কী হইবে, সুভাষচন্দ্র ছাত্রদশাতেই সে কথা ভাবিয়া অনুশীলনে তৎপর। বন্ধু দিলীপকুমার রায় তাহা স্মৃতিকথায় লিখিয়াছিলেন। স্বাধীনতার পরেও অনেক দিন দেশনায়ক ও সাংসদদের অনেকেরই ভাষণ কর্ণসুখকর ছিল। ভাষার নানাত্ব ও আভিজাত্য হিংসা-কাজিয়ার একবর্ণে ঢাকিয়া যায় নাই। এখন বহুত্বের সুদিন অস্তমিত।

অস্তমিত বলিয়াই মাঝে মাঝে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা রাহুল গাঁধীর মতো রাজনীতিবিদদের মুখে সংযতবাক্ হইবার নির্দেশ শ্রুতিসুখকর। বিশেষত ভোটের মরশুমে। কারণ, ভারতবাসী জানেন— লোকসভা হউক, বিধানসভা হউক, পঞ্চায়েত হউক, যে কোনও স্তরের ভোট যত আগাইয়া আসিবে, উত্তেজনার পারদ তত ঊর্ধ্বমুখী হইবে, ভাষা ততই বিবেচনা হারাইবে। জনসভার বক্তারা হয়তো হিংসার ভাষার অনুবর্তী হইবেন। অনুব্রতরা হয়তো নেত্রীর সতর্কবাণী ভুলিয়া যাইবেন। আশঙ্কা হয়, ভোটের তাড়নায় নেত্রীও হয়তো সেই অবাধ্যতাকে মানিয়া লইবেন। তথাপি সতর্কবাণী মূল্যবান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE