হায়, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী! রাষ্ট্রের সিলমোহর তাঁহাকে যে জাতির ‘জনক’ ঘোষণা করিয়াছে, সেই জাতি হিংস্রতা ভিন্ন আর কোনও ভাষা বোঝেই না। জনসভায় দাঁড়াইয়া নেতা যদি বিরোধীদের মনুষ্যেতর প্রাণীর সহিত তুলনা করেন, অথবা বিরোধীদের বোমা মারিবার পরামর্শ দেন, জনতা হাততালি বাজাইয়া হৃষ্টচিত্তে বাড়ি ফিরিয়া যায়। বিরোধীদের মিছিলে যদি লাঠিসোঁটা হাতে ঝাঁপাইয়া পড়ে দলের বাহুবলীরা, তবে ‘যাহা হউক, খুব শায়েস্তা হইল’ ভাবিয়া পাশ ফিরিয়া ঘুমাইয়া পড়েন সমর্থকরা। হিংস্রতা বই আর রাজনীতি জমে না। অতএব, অমিত শাহ যখন বিরোধীদের ‘অহি-নকুল’ অথবা ‘কুকুর-বিড়াল’ বলেন, তিনি জানেন, তাঁহার সমর্থকরা তাহাতে ক্ষুণ্ণ হইবেন না। ভাবিবেন না, ইহাতে গণতন্ত্রের অবমাননা হইতেছে। বরং, তাঁহারা চাঙ্গা হইয়া ঘরে ফিরিবেন। সম্ভবত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানেন, রামচন্দ্র ডোম বা বাসুদেব আচার্যের ন্যায় প্রবীণ বিরোধী নেতাকে আক্রমণ করিলেও তাঁহার সমর্থকরা ভাবিবেন না, ইহা অন্যায়। নেতাদের ধারণাটি নেহাত ভিত্তিহীন নহে। গণতন্ত্রের পরিসরে শারীরিক হিংস্রতা তো বটেই, চিন্তার হিংস্রতারও যে কোনও ঠাঁই নাই, এই কথাটি ভারতবাসী বুঝিতে শিখে নাই।
নেতারাও শিখান নাই। তাঁহারা বরং রাজনীতিকে ‘যুদ্ধ’ হিসাবেই দেখিয়াছেন, দেখাইয়াছেন— এবং, যুদ্ধক্ষেত্রে কিছুই অন্যায় নহে। ফলে, হিংস্রতার ভাষা ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এতখানিই যে, নেতারা সচরাচর সেই ভাষার বাহিরে আর ভাবিতে পারেন না। নরেন্দ্র মোদী মোক্ষম উদাহরণ। নোটবাতিলের পক্ষে সওয়াল করিতে উঠিয়া তিনি বলিয়াছিলেন, পঞ্চাশ দিনের মধ্যে সব স্বাভাবিক না হইলে আমায় জ্যান্ত জ্বালাইয়া দিবেন। পাঁচশো দিনেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় নাই, কিন্তু তাহা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কোনও একটি কথা প্রতিষ্ঠা করিতে এতখানি হিংস্র ভাবনার আশ্রয় না লইলে ভারতীয় রাজনীতির আর চলে না, ইহাই লক্ষণীয়।
তবে, অমিত শাহরা যেমন আছেন, তেমনই রাহুল গাঁধীরাও আছেন। হিংস্রতার বিপরীতে শিষ্টতাও আছে। জনসভায় তাঁহার সমর্থকরা ‘নরেন্দ্র মোদী মুর্দাবাদ’ রবে স্লোগান দিলে রাহুল সমর্থকদের থামাইয়া দিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, ‘মুর্দাবাদ’ কথাটির অর্থ কাহারও মৃত্যু কামনা করা। মোদী তাঁহার ঘোরতর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, কিন্তু তিনি তাঁহার মৃত্যুকামনা করেন না, এবং সমর্থকদেরও করিতে দিবেন না। কথাটি তিনি ঠিক কেন বলিয়াছিলেন, তাহা অনুমানসাপেক্ষ। কিন্তু, সমর্থকদের শিক্ষিত করিয়া তোলা নেতার একটি কাজ। গণতন্ত্রে নেতার ভূমিকা অংশত শিক্ষকেরও বটে। অমিত শাহরা তেমন ‘নেতা’ হইবেন, সেই আশা ক্ষীণ। কেন, তাহার একটি কারণ যথাক্রমে রাহুল গাঁধী বা মনমোহন সিংহ ও নরেন্দ্র মোদীর ভক্তসংখ্যা। ভারতবাসী নিজেদের নেতার মধ্যে এক জন জঙ্গি যোদ্ধাকে দেখিতে চাহেন। অনুমান করা চলে, রাহুলের সেই সভায় যাঁহারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদের একাংশ সে দিন ক্ষুণ্ণ হইয়াছিলেন। মানুষের মনের সুপ্ত হিংস্রতাকে প্রশ্রয় দিয়াই ভারতীয় রাজনীতি চলিতেছে। এই রাজনীতি অমিত শাহ, অনুব্রত মণ্ডলদের। হিংস্রতাই এই রাজনীতির মুদ্রা। গাঁধী প্রতি দিন নিহত হইতেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy