Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ডাক্তারদের সবিনয় নিবেদন

স্বা স্থ্য পরিষেবা মানেই গোলমেলে জিনিস। ঠিক সময়ে ঠিক পরিষেবা ঠিক দামে পাওয়া, এক সমস্যা। সঙ্গে যোগ হয় আরও কঠিন প্রশ্ন।

অরিজিতা দত্ত
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

স্বা স্থ্য পরিষেবা মানেই গোলমেলে জিনিস। ঠিক সময়ে ঠিক পরিষেবা ঠিক দামে পাওয়া, এক সমস্যা। সঙ্গে যোগ হয় আরও কঠিন প্রশ্ন। এই পরিষেবার ঠিক-বেঠিকের মূল্যায়ন করবে কে? রোগী? রোগীর পরিবার? চিকিৎসক? না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ? এই প্রেক্ষিতে বেসরকারি হাসপাতালে মর্মন্তুদ অবহেলা, দুর্নীতি, অমানবিক ব্যবহার, এ রাজ্যের মানুষের কাছে প্রায় দৈনন্দিন দুর্দশা সৃষ্টি করেছিল বা এখনও করছে। তারই মধ্যে ক্লিনিকাল এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট ২০১৭ পাশ হল। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত আপামর বাংলাবাসী আশায় বুক বাঁধল, এ বার বুঝি বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার মান ও মূল্য উভয়ই নাগালের মধ্যে এল। এই আইনে থাকল সরকার দ্বারা সমস্ত পরিষেবার ঊর্ধ্বমূল্য নির্ধারণ করার কথা, থাকল অভিযোগ জানানোর জন্য কমিশনের উপস্থাপনা, যার নির্দেশ ফৌজদারি আইনের ঊর্ধ্বে।

বেসরকারি স্বাস্থ্য সংস্থাগুলির প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল বিব্রত মুখে আংশিক সত্যতা মেনে নেওয়া। ২২ ফেব্রুয়ারি মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নবাণে জর্জরিত, দৃশ্যত বিব্রত কর্পোরেট হাসপাতালের কর্মচারীরা মৃদু প্রতিবাদ ছাড়া প্রায় কিছুই করতে পারেননি। থানায় উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের ডাক পড়তেও সময় লাগেনি। তাঁদের হেনস্থা অনেক পুরনো ক্ষতে প্রলেপ দিয়েছে। শহুরে মধ্য ও মধ্য-উচ্চবিত্ত সমাজে যে ভাবে সমর্থন কুড়িয়েছে, তা এককথায় রাজনীতির মাস্টারস্ট্রোক।

তবে এই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা না বললেই নয়। প্রথমত, ভারত সরকার স্বাস্থ্য বিষয়ে বেসরকারি বিনিয়োগকে অভূতপূর্ব গুরুত্ব দিয়েছে। ২০১০ সাল থেকে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ প্রচুর অনুমোদন পাচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার অটোম্যাটিক রুট-এ। কেন্দ্রীয় নীতি আর রাজ্যের বর্তমান আইন দার্শনিক দিক থেকে পরস্পরবিরোধী, যা স্বাস্থ্যনীতির পক্ষে আদর্শ নয়।

দ্বিতীয়ত, এগারো সদস্যের নিয়ন্ত্রণ কমিশন অভিযোগ সুরাহার জন্য আবশ্যিক নিঃসন্দেহে। কিন্তু যথেষ্ট কি? প্রায় প্রতি দিন কলকাতা থেকে শহরতলি, শহরতলি থেকে আরও দূরের শহরগুলির কোণ থেকে উঠে আসা দুর্নীতি ও অবহেলার হাজারো অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সেটি খুবই অপ্রতুল। তার ওপর কমিশনের কেউই পূর্ণ সময়ের জন্য এই কাজে নিযুক্ত নন। সকলেই অন্য পেশার কাজে ব্যস্ত। তাই আংশিক সময়ের জন্য কর্মরত এই কমিশনের সদস্যরা বিরাট চাপের মুখে পড়বেন। আসলে, যে দেশগুলি স্বাস্থ্য নজরদারিতে পৃথিবীর সামনের দিকে, তারা কিন্তু জোর দেয় ‘নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি’র ওপর। তার মাধ্যমে প্রতিটি রোগীর রোগ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্যের ওপর আবশ্যিক ভাবে অধিকার থাকে সরকার ও জনসাধারণের। তেমনই ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঠিক সফ‌্টওয়্যারে তথ্য আপলোড করা প্রতিটি বেসরকারি সংস্থার অবশ্যকর্তব্য হওয়া উচিত। যাতে থাকবে রোগীর আধার কার্ডের নম্বর, আর্থ-সামাজিক তথ্য, রোগ ও চিকিৎসার সমস্ত খুঁটিনাটি। ফলে একই পরীক্ষা দশ মিনিটে চার বার করা যাবে না, দামও নিতে হবে সমঝে। এই ভাবে মাউসের এক ক্লিকে স্বাস্থ্যভবন আধিকারিক আর রাজ্যবাসী জানতে পারবেন কোন রোগী কী পরিষেবা পেল। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা বা আইসিডিএস, সর্বত্র এই পদ্ধতিতে তথ্য জোগান দেওয়া হয় সমস্ত রাজ্যবাসীকে। এ জন্য প্রতি হাসপাতাল বা ক্লিনিককে ডেটা এন্ট্রি অপারেটর নিযুক্ত করতে হলে শিক্ষিত তরুণদের কর্মসংস্থানও হবে খানিকটা।

এ প্রসঙ্গে অতিসক্রিয় জনসাধারণের কারণে বেসরকারি সংস্থার ডাক্তাররা অনেকেই আতঙ্কিত। রোগীর অবস্থার জন্য তাঁদেরকে অন্যায় ভাবে দায়ী করা হলে তাঁদের অসুবিধা হতেই পারে। কিন্তু যথাযথ নজরদারির প্রেক্ষিত থাকলে তাঁদের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। সঙ্গে অবশ্যই স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল প্রকাশ করা প্রয়োজন। এ কথা মানতেই হবে, ডাক্তাররা আমাদের সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং তাঁদের প্রতি বৃহত্তর সমাজ আজও শ্রদ্ধাপূর্ণ। চিকিৎসা ব্যবস্থার ও পরিষেবার এই সন্ধিক্ষণে তাঁরাই হতে পারেন প্রকৃত ‘বদলের প্রতীক’। সমাজ আজ তাঁদরই পুরোভাগে পেতে চায় কর্পোরেট হাসপাতালের সঙ্গে এই টানাপড়েনে। যে সমাজ চিরকাল ডাক্তারদের ভগবান বলে বিশ্বাস করেছে, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছে, বাজার অর্থনীতির বাইরে গিয়ে নিজের খেতের কলাটা, মুলোটা সওগাত করেছে, সেখানে এই সব বিদগ্ধ ডাক্তােরর কাছে আমাদের আবেদন— তাঁরা যেন বেরিয়ে আসেন অতিরিক্ত মোহজাল থেকে। না হলে বাকিরা তো বটেই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মও তাঁদের ক্ষমা করবে না।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE