য ত দিন বিত্ত উপার্জনে সমর্থ, তত দিনই অনুরক্ত পরিবার। অতঃপর জরা আসিয়া দেহ জর্জরিত করিলে কেহ কুশল জিজ্ঞাসাও করিবে না।’ ‘মোহমুদ্গর’ রচনায় আদি শংকরাচার্যের এই ছিল সতর্কবাণী। সহস্র বৎসরে সংসার বদলায় নাই। সংবাদে প্রকাশ, নগরজীবনে বয়স্কদের জন্য শুশ্রূষা ও পরিচর্যার চাহিদার দ্রুত বৃদ্ধি পাইয়াছে। স্বগৃহে এমন সহায়তা আর সহজলভ্য নহে। তাই বৃদ্ধদের চিকিৎসা ও পরিচর্যার পরিকাঠামো সংবলিত এক আবাসনের উদ্ঘাটন হইল কলকাতায়। ইহা একটি বেসরকারি হাসপাতাল সংস্থা এবং এক আবাসন সংস্থার যৌথপ্রকল্প। ইতিপূর্বে নানা বেসরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য পরিষেবা সংস্থা বয়স্ক রোগীদের স্বগৃহে পরিচর্যার পরিষেবা শুরু করিয়াছে। এমন এক প্রকল্পের চাহিদা এক বৎসরে পাঁচগুণ বাড়িয়াছে। ইহাতে আশ্চর্য হইবার কোনও কারণ নাই। এত দিন বৃদ্ধবৃদ্ধাদের পরিচর্যা পরিবারের, বিশেষত পরিবারের মহিলাদের উপর ন্যস্ত ছিল। কিন্তু উন্নত দেশগুলির পাশাপাশি এখন ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশেও পরিবারের কাঠামো দ্রুত বদলাইতেছে, বিশেষত শহরে। যৌথ পরিবার ভাঙিতেছে, মহিলারা শিক্ষিত এবং কর্মনিযুক্ত হইতেছেন। অনেক সন্তানই পরিবার লইয়া বিদেশে। বৃদ্ধের পরিচর্যার জন্য উদ্বৃত্ত কর্মী জোগান দিতে অক্ষম পরিবার। অপর দিকে, পরিচর্যায় দক্ষতার চাহিদাও বাড়িয়াছে। একটি সেবাপরায়ণ মন এবং দুইটি কর্মতৎপর হাতই যথেষ্ট নহে। চিকিৎসা পূর্বের অপেক্ষা জটিল হইয়াছে, পরিচর্যার প্রকরণও অধিক দক্ষতা দাবি করিতেছে। কিন্তু তাহার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত কর্মী নাই, এবং, তাহার সঙ্গে সঙ্গে, অধিকাংশ বৃদ্ধের প্রয়োজনীয় আর্থিক ক্ষমতাও নাই।
অতএব বৃদ্ধের পরিচর্যাকে কেবল বাজারলভ্য পরিষেবা করিয়া রাখা যথেষ্ট নহে। সরকারকেও বিষয়টির প্রতি নজর দিতে হইবে। স্বগৃহে চিকিৎসা তথা শুশ্রূষার পরিষেবা কী করিয়া সহজলভ্য করা যায়, সেই বিষয়ে যথাযথ নীতি ও সুচিন্তিত প্রকল্প প্রয়োজন। সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্যই ইহা গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। প্রথমত, স্বগৃহে যথাযথ পরিষেবা দিবার ব্যবস্থা থাকিলে হাসপাতালের ‘ক্রিটিক্যাল কেয়ার’ তথা অন্যান্য বিভাগের উপর চাপ কমিবে। শয্যাগুলির যথাযথ ব্যবহার হইবে। দ্বিতীয়ত, স্বগৃহে প্রশিক্ষিত কর্মী দিয়া চিকিৎসার ফল হাসপাতালে চিকিৎসার সমান, কিন্তু তাহার খরচ অনেক কম। তাই স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়েও লাগাম আসিবে। তৃতীয়ত, প্রশিক্ষিত কর্মীদের নিয়োগ ও রোজগারের একটি মস্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত হইয়া আছে। ইহা লক্ষণীয় যে, অপর বহু ক্ষেত্রেই কর্মসংকোচন হইতেছে বটে, কিন্তু স্বাস্থ্য-পরিবেষা ক্ষেত্রে তাহা বাড়িতেছে। স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের পর গৃহকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য পরিষেবায় তরুণ-তরুণীদের নিয়োগ কর্মসংস্থানের একটি বড় উপায় হইতে পারে। অপর পক্ষে, বৃদ্ধ বা তাহার পরিবার যাহাতে আর্থিক কারণে এই পরিষেবাগুলি হইতে বঞ্চিত না হন, তাহার জন্য নানা সরকারি ব্যবস্থা করিয়াছে উন্নত দেশের প্রশাসন। বিশেষ কিছু প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করিলে বার্ধক্যে গৃহপরিচর্যার সুবিধা মেলে। এ দেশে এখনও অবধি কিছু বৃদ্ধাবাস চালাইয়া কাজ সারিতেছে সরকার। আরও অনেক বেশি কার্যকর পরিকল্পনা করিতে হইবে।
সর্বোপরি ভাবিতে হইবে বয়স্ক মানুষটির কথা। জীবনের শেষ এক কিংবা দুই বৎসর অধিকাংশ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকেই নানা শারীরিক সমস্যায় কষ্ট পাইতে হয়। অথচ সেই সময়টি তাঁহারা নিজের ঘরে, আপনজন পরিবৃত হইয়া থাকিতেই ইচ্ছা করেন। বস্তুত মৃত্যু এড়াইবার ইচ্ছার তুলনায় শেষ দিনগুলি অর্থবহ, শান্তিময় রাখিবার ইচ্ছাই তাঁহাদের অনেকের নিকট অধিক গুরুত্বপূর্ণ হইয়া ওঠে। কিন্তু হাসপাতাল-সর্বস্ব চিকিৎসা তাঁহাদের সেই শেষ ইচ্ছা হইতে বঞ্চিত করে। অপরিচিত ঘরে, অনাত্মীয় মানুষের মাঝে তাঁহারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কোনও দেশ, কোনও সমাজ, পরমাত্মীয়ের জন্য এমন মৃত্যু অবধারিত করিতে পারে না। পশ্চিম দুনিয়ায় ‘হসপিস’ পরিষেবা, বিশেষ শুশ্রূষা-সংবলিত বৃদ্ধাবাস হইতে স্বগৃহে প্রশিক্ষিত সহায়তা, এমন নানা পরিষেবা রহিয়াছে। ক্রমশ তাহার সুফলগুলিও স্পষ্ট হইতেছে, সেই সুফল দেখিয়া নাগরিকরা উত্তরোত্তর এই ধরনের ব্যবস্থা চয়ন করিতেছেন। এই দেশকেও সে পথে হাঁটিতে হইবে। পরিবার যাহার পাশে নাই, সেই বৃদ্ধের কুশল নিশ্চিত করিবে রাষ্ট্র।
যৎকিঞ্চিৎ
মা-বাবা আগে ভয় পেতেন, ছেলে বিড়ি খাবে। তার পর মদ, ড্রাগ। নীল তিমি এসে ভয়ের অন্য দিগন্ত খুলে দিল! একটা খেলা এমন, যার শেষ ধাপে আত্মহত্যা! আর তা স্বেচ্ছায় লোকে খেলছে! কেউ বলছে, যাদের বড্ড একা আর উপেক্ষিত লাগে, তারা গ্ল্যামার-খচিত ভাবে সরে যাচ্ছে জীবন থেকে। তবে কি বাচ্চাদের জাপটে থাকতে হবে আর নিত্যি নজর চালাতে হবে তাদের কম্পিউটারকাজে? তখন আবার স্বাধীনতা-হরণের ক্ষোভে এরা তিমি(র)গ্রস্ত হবে না তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy