ভবিতব্য?: উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর বয়ে আনা অতিবৃষ্টিতে প্লাবিত মেরিনা বিচ। চেন্নাই, ৩ নভেম্বর, ২০১৭। ছবি: এএফপি
বাবা-মা’রা বড় ধন্দে পড়েছেন দিল্লিতে: বাচ্চারা বাইরে খেলতে বেরোলে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এই উলটপুরাণের কারণ, বাতাসের দূষণ বিপদমাত্রার পাঁচগুণ। হাওয়ায় যেন ধোঁয়া ভাসছে— আমরা টিভিতে দেখছি, দিল্লিবাসীরা প্রত্যক্ষে।
চেন্নাই ক’দিন টানা বন্যায় ডুবে রইল। সেখানে বৃষ্টিপাত সত্যিই বেশি হয়েছে: দেড় মাসে স্বাভাবিকের পৌনে দু’গুণ, ৭ নভেম্বর সকাল থেকে চব্বিশ ঘণ্টায় সাড়ে তিনগুণ। সেই সাড়ে তিন গুণ কিন্তু মাপে এক ইঞ্চির সামান্য বেশি: তাতেই এই দশা? একই ধরনের বিপর্যয় ভিন্ন ও বৃহত্তর আকারে ঘটেছে আমেরিকার হিউস্টন ও ফ্লরিডায়।
‘সরোবর নগরী’ বেঙ্গালুরুর শোভা ছিল বেল্লান্দুর হ্রদ। দাহ্য পদার্থ জমে তার জলে আজ থেকে-থেকে আগুন ধরে, উঁচুতে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া ওঠে। বর্জ্যের সঙ্গে বৃষ্টির সংমিশ্রণে বিষাক্ত ফেনা পাড় ছাপিয়ে রাজপথ ভাসিয়ে দেয়।
কলকাতায় আমরা কত ভাল আছি, না?
২০১৫-র নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কলকাতার বাতাসে পিএম ১০ (১০ মাইক্রোমিটারের কম ব্যাসযুক্ত পার্টিকুলেট ম্যাটার বা কণা) দূষণকণার মাত্রা একদিন বিপদসীমা সামান্য ছাড়িয়েছিল; ২০১৬-তে দু’দিন, গড় মাত্রাও বেড়েছিল খানিক। এ বছর রোজ প্রায় সর্বত্র ছিল বিপদসীমার উপরে, দৈনিক গড়ে ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত বেশি, সময়বিশেষে বিপদমাত্রার চারগুণ। ২০১৬ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কলকাতায় বায়ুদূষণের সূচক (এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স) ছিল বিপদমাত্রার সাড়ে তিনগুণ, দিল্লির চেয়ে ঈষৎ কম; উপরোক্ত অনুপাতে বাড়লে এ বছর কোথায় দাঁড়াবে? সবচেয়ে মারাত্মক পিএম ২.৫ দূষণকণার কোনও স্পষ্ট হিসাব নেই। তার বড় উৎস ডিজেলের ধোঁয়া, আর কলকাতা নাম কিনেছে ভারতের ‘ডিজেল রাজধানী’ বলে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ পিএম ২.৫ মাপে ছেড়ে-ছেড়ে, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। হালফিলের গড় আন্তর্জাতিক মানের অন্তত দ্বিগুণ, ভারতের ঢিলেঢালা ঊর্ধ্বসীমার ১৫ থেকে ৪৫ শতাংশ বেশি। (অন্য সূত্র অনুসারে সময়ে-সময়ে ভারতীয় সীমার তিনগুণে পৌঁছয়।) অন্য দু’একটি দূষকের পরিমাণ অত মারাত্মক নয়, কিন্তু উপরেরগুলিই প্রধান।
রাজ্য পর্ষদের ওয়েবসাইটের তথ্য এত বিক্ষিপ্ত যে সারা বছর তো বটেই, এক দিনেরও পুরো ছবিটা ফুটে ওঠে না। এ দিকে কেন্দ্রীয় পর্ষদ কলকাতার বায়ুদূষণ মাপা বন্ধ করেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, দূষণকবলিত এই মহানগরে বায়ুপরীক্ষার কোনও সার্বিক ব্যবস্থা নেই। ফলে সমস্যাটা এড়িয়ে যাওয়া, ভুলে থাকা, এমনকী অস্বীকার করার পথ প্রশস্ত।
গঙ্গা পবিত্র নদী, কলুষিত হতে পারে না, কিন্তু দূষিত হতে বাধা নেই। তার অবস্থান বিশ্বের পাঁচ-ছ’টি সবচেয়ে দূষিত নদীর তালিকায়, কখনও-বা শীর্ষে। অববাহিকার নগরবহুল শিল্পায়িত অংশে জলদূষণ ভয়াবহ, সবচেয়ে বেশি কানপুরের কাছাকাছি। যাত্রাশেষে বাংলায় পৌঁছতে-পৌঁছতে দূষণ চরমে পৌঁছবে তা অপ্রত্যাশিত নয়; কিন্তু ভাগীরথী-হুগলির প্রায় ৫০ শতাংশ দূষণ পশ্চিমবঙ্গেরই দান— কিছুটা শিল্পের, বেশিটা পয়ঃপ্রণালীর ময়লা। রাজ্য পর্ষদের ওয়েবসাইটে হালের জলতথ্যে মল-জীবাণুর (ফেকাল কলিফর্ম) হিসাব নেই। ৭ অগস্ট গার্ডেনরিচে ছিল ভারত সরকারের মাপকাঠি অনুসারে বিপদসীমার ৩০ গুণ, ৮ অগস্ট দক্ষিণেশ্বরে ৫০ গুণ। (আন্তর্জাতিক মাপকাঠি আরও অনেক কড়া।) দৈনিক আর গড় হিসাবের চরিত্র আলাদা, তবু বলতে হয়, এই দুই জায়গায় ২০১১-য় কেন্দ্রীয় পর্ষদের গড় হিসাব ছিল যথাক্রমে ১৬ ও ২৭ গুণ।
বর্জ্য ও পয়ঃপ্রণালীর জন্যই চেন্নাইয়ের আদিয়ার ও কুয়ম নদী আর বাকিংহাম খাল গতিহীন, বিষাক্ত ও স্থানে-স্থানে প্রায় নিশ্চিহ্ন। নাভিশ্বাস উঠছে হায়দরাবাদের হুসেন সাগরের বদ্ধ জলের। গত ষাট বছরে বেঙ্গালুরুর হ্রদের সংখ্যা ২৮০ থেকে কমে ৪০-৫০টায় ঠেকেছে।
তার বৃহত্তম দুটি— বেল্লান্দুর ও ভার্তুর— এবং আরও অনেকগুলি বর্জ্যে বিপর্যস্ত; যেগুলি ‘সুরক্ষিত’, সেগুলিও প্রাকৃতিক চরিত্র হারিয়ে প্রমোদভূমিতে পরিণত।
নদীমাতৃকা বাংলার কথা আলাদা, কিন্তু মায়ের উপর জুলুম একটু বাড়াবাড়ি রকমের হচ্ছে, দৃষ্টান্ত: লুপ্ত সোনাই নদী এবং প্রায়লুপ্ত বিদ্যাধরী, মায় আদিগঙ্গা। চেন্নাইয়ের বাকিংহাম খালের মতো আদিগঙ্গার গতিপথ ধরে বসেছে মেট্রো রেলের থাম: নদী মজিয়ে দেওয়ার এমন উপায় বেশি নেই। একই কারণে এক হাল মালয়েশিয়ার কুয়ালা লামপুরে গোমবাক নদীর, ফলে সেখানেও শহরের একাংশ বর্ষায় ডুবে যায়।
আদিগঙ্গাকে আমরা অনেক অত্যাচার করেও রেহাই পাচ্ছি, কারণ এটা শহরের বর্জ্য জলের প্রধান নিকাশপথ নয়। দক্ষিণবঙ্গে খাল-বিল-পুকুর এত প্রচুর যে অক্লান্ত চেষ্টাতেও সবগুলি বোজানো যায়নি; যতটা হয়েছে তাতে বর্ষার জল নিষ্কাশনে প্রবল বাধা ঘটছে, যেমন বেহালা অঞ্চলে। ভিআইপি রোডের নয়ানজুলি উদ্ধারের অতীত; লেকটাউন-বাঙুরে বর্ষায় বন্যার এটা এক কারণ। (সম্প্রতি অন্য উপায়ে অবস্থার উন্নতি হয়েছে।)
সর্বোপরি বলতে হয় পুব কলকাতার জলাভূমির কথা। বেঙ্গালুরুর অবশিষ্ট হ্রদগুলির মোট আয়তন ১,০০০ হেক্টেয়ার; পুব কলকাতার জলাভূমির বিস্তার ১২,৫০০ হেক্টেয়ার। কলকাতায় তরল বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের কোনও যান্ত্রিক ব্যবস্থা নেই, দরকারও নেই। পয়ঃপ্রণালীর সমস্ত জল মায় বর্ষার স্রোত জলাভূমি ও কুলটি নদী দিয়ে সুন্দরবনে পড়ে। এক পয়সা খরচ নেই, বরং পথে বড়-বড় জলাশয়ে পরিস্রুত হয়ে সেই জল থেকে প্রচুর মাছ ও সবজি উৎপাদন হয়, রুজি হয় হাজার পঁচিশ পরিবারের। নগরসংলগ্ন এত বড় দূষণমুক্ত এলাকাটা ‘কার্বন সিংক’ হিসাবে শহরের বিষাক্ত বাতাস কিছুটা নির্মল করে। অন্যান্য শহরে বর্জ্য পরিশোধনের যে যান্ত্রিক ব্যবস্থা, কলকাতায় তা বসাতে কত টাকা লাগবে ইয়ত্তা নেই (২০১৬-র এক হিসাবে ১৩,৫০০ কোটি, তার পর ফি-বছর ১০০ কোটি), নেই সেটা সুষ্ঠু ও পর্যাপ্ত হওয়ার কোনও আশ্বাস।
ছোট পরিসরে তুলনা করা যাক চন্দননগরের ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্কের সঙ্গে। বেড়াবার জায়গা হিসাবে এটি মনোরম ও জনপ্রিয়। তাই হয়তো উহ্য থাকে যে, নীচে বর্জ্য জল প্রযুক্তি দিয়ে পরিশোধিত হয়, কিন্তু তা এলাকার মোট জলের মাত্র ১০ শতাংশ। মোক্ষম তুলনা মুম্বইয়ের পাওয়াই হ্রদের সঙ্গে। সেখানে নিকাশ-করা বর্জ্যের মোকাবিলায় যন্ত্র বসানো হয়, বিকলও হয় যথারীতি।
২০০৭-এ কেন্দ্রীয় রিপোর্ট বলে, অবস্থা ‘খুবই শোচনীয়’। আজ তা সঙ্গিনে পৌঁছেছে: মাছচাষ বিপন্ন, স্থানীয় পরিবেশবিদরা আন্দোলনে নেমেছেন।
২০১৩-য় পশ্চিমবঙ্গের ৩৪টি বর্জ্য-জল কেন্দ্রে দৈনিক ২১৪ মিলিয়ন লিটার অর্থাৎ মোট ক্ষমতার অর্ধেকেরও কম জল পরিশোধিত হয়েছিল; বিকল ছিল ১৩টি কেন্দ্র। তুলনায় পুব কলকাতা নিষ্কাশন করে দিনে অন্তত ৭৫০ মিলিয়ন লিটার। যন্ত্রের বালাই নেই বলেই তা নীরবে নির্ঝঞ্ঝাটে পরিস্রুত ও নিকাশ হয়ে চলেছে। একটা বিশাল মহানগরের বর্জ্য নিখরচায় সদ্ব্যবহারের এমন উৎপাদনশীল কর্মবান্ধব পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা দুনিয়ায় কোথাও নেই। জলাভূমি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক রামসার সংগঠন একে নগরকল্যাণে জলাভূমি ব্যবহারে বিশ্বসেরার শিরোপা দিয়েছে, পুনরুল্লেখ করেছে ২০১৭-য়। খবরটা আমরা রাখি?
কন্যাশ্রী প্রকল্প বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেয়েছে, এমন অভিনব ও ফলপ্রসূ প্রকল্পের পাওয়াই উচিত ছিল। ‘বিশ্ববাংলা’র নিদর্শন হিসাবে জলাভূমির ব্যবহারও কিন্তু কম অভিনব ও উপকারী নয়। একশো বছর আগে, বিশ্বে যখন পরিবেশচেতনা বলতে গেলে জন্মায়নি, কলকাতার উপকণ্ঠের অনামী উপেক্ষিত জনসত্তা এই আশ্চর্য ব্যবস্থাটির উদ্ভাবন করেছিল। দুনিয়ার পরিবেশবিদ আজও তা নিয়ে মুগ্ধ, হুঁশ নেই কেবল নগরবাসীর। কন্যাশ্রীর সাফল্যে সংগতভাবেই রাজ্য জুড়ে আনন্দ ও প্রচারের জোয়ার; জলাভূমি নিয়ে না হল একটা অনুষ্ঠান, না দেখলাম একটা হোর্ডিং, এমনকী সেই বাইপাসেও, যার ও-পাশ থেকে জলাভূমি শুরু।
অথচ, উৎসব-অনুষ্ঠান দূরে থাক, জলাভূমির অবস্থা এখন ‘ভিক্ষা চাই না হুজুর, কুকুর সামলান।’ ১৯৯২-এ হাই কোর্টের আদেশ, অন্যান্য আইনি বিধান ও রামসার চুক্তি মোতাবেক সেখানে সমস্ত নির্মাণ ও জমির চরিত্র পরিবর্তন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। জলাভূমি দখল কিন্তু রমরমিয়ে চলছে: দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ভগবানপুর মৌজায় ২০০২ থেকে ২০১৬-র মধ্যে জলের পরিমাণ ৮৮ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১৯ শতাংশ। এর বৃহত্তম কারণ, বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের ভাষায়, জলাভূমি হল অপেক্ষমাণ বাস্তুজমি, ‘রিয়েল এস্টেট ইন ওয়েটিং’: তার উপর প্রমোটরের লোলুপ থাবা। কিছুদিন যাবৎ ধ্বংসটা নতুন মাত্রা পেয়েছে: তাতে যোগ হয়েছে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন।
অবৈধ ও অথ-বৈধ মিলিয়ে জলাভূমিতে গড়ে উঠেছে অজস্র ইমারত, অন্তত একটি কলেজ ও একাধিক স্কুল। বিরাট দেয়াল-ঘেরা এলাকায় মাথা তুলছে আবাসন প্রকল্প। সেখানে যাঁরা ফ্ল্যাট কিনছেন, আইনের প্রশ্ন দূরে থাক, চোরাপথে ভরাট জমি কতটা পোক্ত, ভবিষ্যতে কী পরিকাঠামো মিলবে, এ সব ভেবেছেন কি? জলাভূমির সরকারি পরিচালক সংস্থা পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেছেন তিনশোর উপর; তার পর কী সংস্থা কী পুলিশ উভয়ে নীরব। সবচেয়ে চিন্তার কথা, পরিচর্যা ও উন্নয়নের নামে সরকারি উদ্যোগে জলাভূমি ধ্বংসের এক নতুন নজির সৃষ্টি হচ্ছে।
জল থাকলেই জলাভূমি হয় না। জলাভূমি হল জল ঘিরে একটা জৈব পরিমণ্ডল। তাতে অল্পবিস্তর ডাঙাও থাকবে; জীবাণু, শেওলা ও পোকামাকড় থেকে শুরু করে সব রকম উদ্ভিদ ও জীবজন্তু নিয়ে সেখানে প্রকৃতির যে ভরপুর সংসার, সেটাই জলাভূমি। অতএব জলটুকু বজায় রেখে (বাস্তবে যা অসম্ভব) পাড় বাঁধিয়ে, গাছ ও পশুপাখি অবধারিত ভাবে হটিয়ে, বিহার ও বিনোদনের ব্যবস্থা করলে জলাভূমির বদলে সৃষ্টি হয় কংক্রিটের চৌবাচ্চা। এমন প্রমোদক্ষেত্রের সঙ্গে জলাভূমির সম্পর্ক, ফুলদানির ফুলের সঙ্গে শিকড়গাড়া গাছের মতো। সিঙ্গাপুরের জুরং বার্ড পার্কের ধাঁচে একটি পাখিরালয়ের প্রস্তাব শোনা যাচ্ছে। জুরং পার্ক কিন্তু অভয়কানন নয়, চিড়িয়াখানা— সেখানে পাখি খাঁচায় থাকে। জায়গাটি সুন্দর ও শিক্ষামূলক, বাংলায় অন্যত্র অমন একটা হলে ভালই হয়; তবে পুব কলকাতার বিখ্যাত পক্ষীবৈচিত্র মুক্ত পরিবেশে রক্ষা করার এটা উপায় নয়।
অন্য কয়েকটি প্রকল্পে সংরক্ষণের নামগন্ধ নেই, যেমন উড়ালপুলের ধাঁচে একটি রাজপথ। ঠিকই বলা হচ্ছে, এতে জমি লাগবে নামমাত্র; কিন্তু যেটুকু লাগবে তা ভেঙে-ভেঙে, জলাভূমি চিরে সার দিয়ে থাম বসাতে, অতএব নির্মাণের সময়েই গোটা অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত হবে; উপর দিয়ে যে গাড়ি যাবে, তার নির্গত দূষণে কার্বন সিংক হয়ে দাঁড়াবে কার্বনের উৎস।
অন্য দিকে অবৈধ দখলের নতুন প্রকাশ, জলের পাড় ধরে প্লাস্টিক, চামড়া আর চামড়ার বর্জ্যের কারখানা। এর অবশ্যম্ভাবী ফল, সমস্ত প্রাণিসম্পদ ক্রমে বিষক্রিয়ায় মরবে, মাছের চাষ উঠে যাবে (মুম্বইয়ের পাওয়াই হ্রদের হাল স্মর্তব্য); শেষে বেঙ্গালুরুর বেল্লান্দুর হ্রদের মতো জলে আগুন জ্বলবে, বিষ-ফেনা ছড়াবে জবরদখল আবাসনগুলিতে। সেই সঙ্গে কলকাতার বায়ুদূষণ দিল্লিকে টেক্কা দিতে এগোবে। ভারত আজ যা ভাবছে, বাংলাও কাল তা-ই ভাববে।
তার চেয়ে বরং শুভ ও বিপরীত অবস্থাটা ভাবা যায় না? রবীন্দ্রনাথ থেকে রসগোল্লা, বাঙালির গর্বের তালিকায় পুব কলকাতার জলাভূমির তারকা-স্থান প্রাপ্য, পরিবেশরক্ষার ইতিহাসে আমাদের উজ্জ্বল অবদান হিসাবে। তার চেয়েও বড় কথা, আমাদের নাগরিক সত্তা, সচেতনতা ও প্রয়োজনে প্রতিবাদের ঐতিহ্য পরিবেশের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা না করলেই নয়। দু’একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা তো পথ দেখাচ্ছে। ভবাদিঘির পাড়ের বাসিন্দারা তাঁদের স্থানীয় জলাভূমি রক্ষায় বদ্ধপরিকর। যশোহর রোডের গাছ বাঁচাতে কিছু স্কুলছাত্র হাই কোর্ট অবধি ছুটেছে, ন্যায়ালয় তাদের নিরাশ করেনি।
এটা কেবল গর্ব বা প্রকৃতিপ্রেমের বিষয় নয়, আক্ষরিক অর্থে বাঁচার লড়াই। পুব কলকাতার জলাভূমি বুজলে একদিন চেন্নাইয়ের মতো কলকাতাও বৃষ্টিতে হপ্তাভর ডুবে থাকবে (এখনই থাকে কোথাও কোথাও), শেষে পয়ঃপ্রণালীর নিকাশ বন্ধ হবে। তত দিনে হাওয়ায় ভাসবে আরও বিষ, শহরময় শিশু জীবন শুরু করবে পঙ্গু ফুসফুস নিয়ে (এখনই করে বিপুল সংখ্যায়)।
যে মায়েরা সন্তান দুধ না খেলে উতলা হন, তাঁরা ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখবেন। ভেবে দেখবেন সেই সব দম্পতি, যাঁরা জীবনশেষের সঞ্চয় বা জীবনারম্ভের ঋণ দিয়ে মাথা গোঁজার সংস্থান করছেন। যে জল-মাটি-বায়ু আমাদের সবচেয়ে নিশ্চিত সহায়, তাদের সঙ্গে আমরা লাগামছাড়া বেইমানি করছি। তারা ইতিমধ্যেই প্রতিশোধ নিচ্ছে, একদিন সেটা হবে মর্মান্তিক।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy