প্রতিপক্ষকে ঘৃণা করা নিজের দুর্বলতার লক্ষণ— এক রাজনীতিকের উক্তি। উক্তিটি শুনিলেই চেনা চেনা লাগে, কত যুগে কত নেতা এমন কথা বলিয়াছেন, মনে পড়ে। বিশেষত মহাত্মা গাঁধীর মুখটি চিত্তমধ্যে উজ্জ্বল বিভায় উদিত হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ইহাও অস্বীকার করা যায় না, কথাটি বহুশ্রুত হইলেও সম্প্রতিকালে যেন অধিকশ্রুত নয়! কোথায় যেন তাহা হারাইয়া গিয়াছিল, আবার ভাসিয়া উঠিল। সামান্য থমকাইয়া ভাবিতে হয়, কে ইনি? কেন বলিলেন কথাটি? অনুসন্ধান বলিতেছে, উচ্চারণকারীর নাম, রাহুল গাঁধী। উচ্চারণের প্রেক্ষিত, তাঁহার অতি-উচ্চাশী সমর্থকদের মুখে ভারতকে ‘সংঘ-বিজেপি-মুক্ত’ করিবার প্রতিজ্ঞা। রাহুল গাঁধী তাঁহাদের সাবধান করিয়া বলিয়াছেন, কোনও দল বা গোষ্ঠী হইতে দেশকে ‘মুক্ত’ করিবার কথায় ঘৃণার মাত্রাটি অত্যধিক, অত ঘৃণার প্রয়োজন নাই। বিজেপি কংগ্রেস-মুক্ত ভারত তৈরি করার কথা বলুক, কিন্তু কংগ্রেস কর্মীরা যেন বিজেপি-মুক্ত দেশের কথা না বলে। বিজেপির সমর্থনেও মানুষের অধিকার আছে, কোনও আত্মপ্রত্যয়শীল রাজনীতি তাহা উপেক্ষা করিতে পারে না। রাজনীতি কেবল নিজের কথা বলিতে পারে, বিকল্প ও বিরুদ্ধ রাজনীতির সহিত লড়িতে পারে। বিরোধীকে উধাও করিবার দায় তাহার নয়। প্রসঙ্গক্রমে রাহুলের উল্লেখ: তিনি ও প্রিয়ংকা তাঁহাদের পিতার হত্যাকারীর প্রাণদণ্ডের আদেশেও খুশি না হইয়া বিষণ্ণ হইয়াছিলেন। অর্থাৎ তাঁহার বার্তা, দলের নামে সংকীর্ণ অন্ধতা হইতে বাহির হইয়া আসিতে হইবে, মুক্ত গণতন্ত্রের অঙ্গনে লড়িয়া জিতিতে হইবে।
কথাগুলি আক্ষরিক ভাবে লইবার পক্ষে একটু বেশিই ‘ভাল’। রাহুল গাঁধী নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ারে যে এমন অসাধারণ নৈতিক উচ্চতার ধারাবাহিক পরিচয় রাখিয়া আসিয়াছেন, এ কথাও বলা অসম্ভব। ইহাও ঠিক, প্রতিপক্ষ দলের অতিস্পর্ধিত প্রচারের সুযোগে বিবেকবান রাজনীতি তৈরির আপ্রাণ প্রচেষ্টাও তাঁহার বক্তব্যে স্পষ্ট। নিন্দুক প্রশ্ন তুলিবেন, ইহা তো নেহাত ‘জার্গন’, বক্তৃতার অলংকার, এতখানি অনুধাবনের যোগ্য কি? উত্তরে একটি জরুরি কথা বলিতে হয়। রাজনীতির ‘জার্গন’ও কিন্তু বিশেষ অনুধাবনযোগ্য বিষয়, যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, কেননা জার্গনের মোড়কেই নেতাদের বার্তা, নির্দেশ ও মনোবাসনা জনসমাজে পৌঁছায়। অন্তত জার্গনের স্তরেও যে শুভবুদ্ধির কথা ভাবা ও বলা যায়, সেই অভিজ্ঞতা ভারতীয় রাজনীতিতে ক্রমশই দুর্লভ হইয়া পড়িতেছে। মোদী সরকারের আমলে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও ‘হেট-পলিটিকস’ বা কদাচারী রাজনীতির বিরাট রমরমা অতি পীড়াদায়ক হইয়া উঠিয়াছে। রাহুল গাঁধীর কথা বলিতে গিয়া বিজেপি নেতারা অকারণ কুকথার বন্যা বওয়াইছেন: যেমন, কেহ তাঁহার সহিত কন্যার বিবাহ দিবেন না, ইত্যাদি। সভ্য রাজনীতির মানদণ্ডগুলিই যেন এই দেশ হঠাৎ হারাইয়া বসিয়াছে।
সুতরাং, কিছু অতিরঞ্জন ও আলংকারিকতা সত্ত্বেও, প্রথমোক্ত মন্তব্যটির গুরুত্ব বিরাট। প্রধান বিরোধী দলের নেতা যখন এ কথা বলেন, তাঁহার রাজনীতির বহু খামতি সত্ত্বেও কিছুটা বোনাস নম্বর তাঁহাকে দিতেই হয়। বিশেষত, রাহুল গাঁধীর মুখে কিন্তু এমন কথা এই প্রথম বার নয়। গত উত্তরপ্রদেশ-নির্বাচনের সময়ও তিনি জনসভায় সমর্থকদের আরজি জানাইয়াছিলেন, খামকা ব্যক্তিগত আক্রমণ না করিয়া রাজনৈতিক আক্রমণের দিকে মন দিতে বলিয়াছিলেন। মোদীর ব্যক্তিজীবনের প্রতি শাণিত বাক্যবাণ না বর্ষাইয়া আরএসএস মতাদর্শ ও মোদীর ক্ষমতান্ধতার দিকে নির্দেশ করিয়াছিলেন। দেশের উচ্চ নেতৃত্বের কোনও একটি কোণ হইতে যে আজও রাজনীতিকে একটি সুস্থ দিশা দিবার আগ্রহ অবশিষ্ট রহিয়াছে, প্রমাণ পাইলে দেশবাসীর মনে আশ্বাস জাগে। ধন্যবাদ জ্ঞাপনের আকাঙ্ক্ষা জন্মে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy