ফের মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষায় বসিতে হইতেছে, এমন একটি দুঃস্বপ্নে কত লোক যে মধ্যরাত্রে ঘর্মাক্ত কলেবরে ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়াছেন, সেই হিসাবটি জানা গেলে বেশ হইত। তাঁহাদের অবশ্য বাঁচোয়া, ঘুম ভাঙিলেই আর ভয় নাই। কিন্তু, যাহারা এখনও মাধ্যমিকের চৌকাঠ পার হয় নাই, তাহাদের নিস্তার নাই— অঙ্ক কষিতেই হইবে। ভারতে বহু ছেলেমেয়েই দশম শ্রেণির পরীক্ষায় গণিতের বেড়া টপকাইতে ব্যর্থ হইয়া লেখাপড়া ছাড়িয়া দেয়। গণিত ঐচ্ছিক হইলে হয়তো তাহারা আরও খানিক পড়িতে পারিত, এবং— অমর্ত্য সেন সাক্ষ্য দিবেন— অধিকতর উন্নয়নের সুযোগ পাইত। নবম শ্রেণি হইতে গণিতকে ঐচ্ছিক করা যায় কি না, বম্বে হাইকোর্ট সেই প্রশ্নটি তুলিয়াছে। যে মেয়েটি পরবর্তী কালে ইতিহাস পড়িবে, অথবা যে ছেলেটি ব্যবসা করিবে, তাহাদেরও কেন সাইন থিটা-র সহিত ট্যান থিটা-র গূঢ় সম্পর্ক লইয়া নাকাল হইতে হইবে, সত্যই সেই প্রশ্নের উত্তর নাই। কিন্তু, পাঠ্যক্রম হইতে গণিতকে ছাঁটিয়া ফেলিলে কি ভিন্নতর সমস্যার মুখে পড়িতে হইবে না?
শুধু তথ্যপ্রযুক্তির গজদন্তমিনারই নহে, নিতান্ত প্রাত্যহিকতাও এখন সংখ্যানির্ভর। গণিতের সহিত সম্পর্কহীনতা এক নূতন নিরক্ষরতার জন্ম দিবে। ছাত্রছাত্রীরা যদি জানে যে অষ্টম শ্রেণির পর আর অঙ্ক না কষিলেও চলিবে, তবে গণিতের প্রাথমিক পাঠও অসম্পূর্ণ থাকিতে পারে। গণিতের মাধ্যমে যুক্তিনির্ভর চিন্তার যে অভ্যাস হয়, অন্তত হওয়ার কথা, তাহাতেও ফাঁক পড়িবে। কাজেই, গণিতকে বাদ দেওয়ার বদলে তাহাকে উপযোগী ও তাহার শিক্ষণপদ্ধতিকে উন্নত করাই উচিত কাজ। অষ্টম বা নবম শ্রেণি হইতেই গণিতের দুইটি পৃথক পাঠ্যক্রম চালু করা যায়। প্রথমটি বর্তমান পাঠ্যক্রমের অনুরূপ— ভবিষ্যতে যাহারা গণিতনির্ভর বিষয় পড়িবে, অথবা যাহাদের নিকট গণিত ভীতিপ্রদ নহে, তাহাদের জন্য। অঙ্ক দেখিলেই যাহারা সাত হাত দূরে পালায়, দ্বিতীয় পাঠ্যক্রমটি তাহাদের জন্য। সেই পাঠ্যক্রমে উচ্চতর গণিতের ইশারা থাকিবে না, বরং তাহা সংখ্যা-সাক্ষরতার পাঠ্যক্রম হইবে। পাটিগণিত-নির্ভর, বাস্তবমুখী গণিত। দুইটি পৃথক ঋণের মধ্যে তুলনা করিবার জন্য যে গণিত প্রয়োজন, অথবা কোনও লেখচিত্র বুঝিতে যতটুকু জ্ঞান প্রয়োজন, ততটুকুই।
শুধু গণিত নহে, সম্পূর্ণ স্কুলশিক্ষাকেই এমন দুইটি ভাগে— ধরা যাউক, বেসিক ও অ্যাডভান্সড— ভাগ করিয়া লওয়া সম্ভব। প্রতিটি বিষয়েরই দুই স্তরের পাঠ্যক্রম থাকিবে। প্রতি ক্ষেত্রে পছন্দসই স্তর চয়নের অধিকার থাকিবে ছাত্রদের। তাহাতে বহুবিধ লাভ। যাহারা উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী নহে, তাহারা অনেক কম বোঝা বহিয়া, কিন্তু কাজের জিনিসগুলি শিখিয়া, স্কুলশিক্ষা শেষ করিতে পারিবে। যে ছাত্র সাহিত্যে পারদর্শী, সে অঙ্ক বা জীববিজ্ঞানের ভয়াবহতাকে বাদ রাখিয়াই আগাইতে পারিবে। আর, যাহার অঙ্ক পছন্দ, কিন্তু ইতিহাসের নামে জ্বর আসে, তাহারও সমস্যা থাকিবে না। এই সংস্কার করিতে হইলে অবশ্য ভারতীয় স্কুলশিক্ষার ফলিত দর্শনটিকে বদলাইতে হয়। শিক্ষা যে ছাত্রদের অগ্রসর হইতে সাহায্য করিবার জন্য, তাহাদের খামতির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিবার জন্য নহে, এই কথাটি বিশ্বাস করিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy