Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
নারীকে শ্রদ্ধা আর নারীকে অনুকম্পা এক নয়

মেয়েদের সমান ভাবলে, তাঁরা খারাপ খেললে তো তেড়ে গালাগাল দিতাম

এই এক্সট্রা হাততালি ও কৃপা-ল্যাবেঞ্চুস ছিটিয়ে নিজের পিঠ-চাপড়ানোর অভ্যাস আমাদের মজ্জায়। রিয়েলিটি শো-তে অন্ধ প্রতিযোগী ভাল গাইলে আমরা লাফাই, রাশি রাশি নম্বর দাও! আমরা যে দিন তাকে সেই নম্বর দিতে শিখব, ওই গান এক চক্ষুষ্মান ব্যক্তি গাইলে এগজ্যাক্টলি যত পেত, সে দিন তাকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাব। তাকে সমান মর্যাদা দেব।

যন্ত্রণা: যা লড়াইয়ের সসম্মান স্বীকৃতি চায়, ফাঁপা বাহবা নয়। লর্ডস, ২৩ জুলাই ২০১৭। ছবি: এএফপি

যন্ত্রণা: যা লড়াইয়ের সসম্মান স্বীকৃতি চায়, ফাঁপা বাহবা নয়। লর্ডস, ২৩ জুলাই ২০১৭। ছবি: এএফপি

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৭ ০৮:০০
Share: Save:

আজকাল তরল ফেমিনিজ্ম একটু বাড়তির দিকে। ফুটফুটে পলিটিকাল কারেক্টনেসের একটা হাওয়া উঠেছে, তাতে ‘ওরে মেয়েরাও কিন্তু ছেলেদের সমান’ ফুকারি উঠে নিজের পুণ্যপয়েন্ট কিছু বাড়িয়ে নেওয়ার সস্তা বাতাসা যে পারছে কুড়োচ্ছে। তাতে এমনিতে অসুবিধে নেই। বরং সমাজ সুস্থতার দিকেই ঢলে পড়ার সম্ভাবনা। মুশকিল হল, বেসিক অশিক্ষা থেকে আচমকা নৈতিক ঠিকতার পানে ডাইভ মারলে, প্রাণপণ পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে যান্ত্রিক নারী-তোল্লাইয়ের দিকে তুড়িলাফ কষালে, কিছু হাস্যকর মুদ্রা ও দোষ অবশ্যম্ভাবী, তাতে পরনের কাপড় একটু বিপজ্জনক ভাবে উড়ে যায়। সম্প্রতি মেয়েদের ক্রিকেটের বিশ্বকাপ হল, কোনও বারই তা বিশেষ পাত্তা পায় না, এ বার মিডিয়া একেবারে হুড়িয়ে কভার করল, সবাই বেশ হাতটাত নেড়ে কথা বলতে লাগল, বিশ্বকাপ জেতার পর নারী ক্রিকেটাররাও মিনিমাগনা ফ্ল্যাট পাবেন এমন সিনারি তৈরি হল। ‘ছেলেদের ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি করলে মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি না-করার অধিকার কোথায়’ গোছের রাঙাচোখে অনেকেই তাকাতে লাগলেন। তার পর হল বিশ্বকাপ ফাইনাল। বৃষ্টি-বাদলা, রোববার সন্ধে, অতএব অনেকেই মুড়িফুড়ি মেখে জাঁকিয়ে দেখতে বসলেন। জেতা ম্যাচ ভারত একেবারে যাচ্ছেতাই ভাবে মাঠে ছেড়ে দিয়ে এল। এখন ক্রিকেট সকলেই বোঝেন, যে খেলা অনায়াসে তালুবন্দি করে হাসতে হাসতে জেতা যায়, সে ম্যাচ হেরে বসতে গেলে যে কতটা বিচ্ছিরি খেলতে হয়, স্রেফ টেনশনে দম আটকে নিজেই নিজেকে হারাতে হয়, তা টের পেতে কারও আর কমেন্ট্রি-নির্ভর হতে হয় না। এই হার দেখার পর কী হল? সব্বাই করুণা-ছলছল পোজে বলতে লাগলেন, আহা গো, তাতে কী হয়েছে, এত দূর যে গিয়েছিল, এই কি যথেষ্ট নয়? কেউ টুইট করলেন, তোমরাই আসলে চ্যাম্পিয়ন! কেউ এমনকী বললেন, না-হারলে জেতার আনন্দ বোঝা যায় না! পর দিন মিডিয়ার হেডলাইন দেখেও মনে হল, সবাই সান্ত্বনার আঙুল বুলিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। আহা ননীপুতুলকে বোকো না গো, যথেষ্ট চেষ্টা করেছে, মেয়েকে আমার বড়কা সন্দেশ দাও।

এই যদি ছেলেদের ক্রিকেটে, ভারতীয় ক্রিকেট দল, ৪৪ বলে ৩৮ করতে হবে আর হাতে সাত উইকেট আছে এই অবস্থায় ম্যাচ হেরে ফিরত? ২৮ রানে ধড়াধ্ধড় বাকি উইকেট হারিয়ে চলে আসত? কী হত? প্রায় দাঙ্গা। ছ্যারছেরিয়ে খিস্তি, র‌্যান্ডম কুশপুতুল পোড়ানো। কেউ বলত অমুকের মুন্ডু লাও, কেউ বলত নির্ঘাত টাকা খেয়েছে, কেউ চেঁচিয়ে ফাটিয়ে দিত: রিভিউ চাইতে দেরি হয়ে গেল বলে রিভিউ পেল না, এমন ক্রিকেটার জাতীয় টিমে ঢোকে কী করে? বাড়িতে ইট-পাটকেলও পড়ত, পুলিশ দিয়ে ম্যানেজ করতে হত। না, এগুলো খুব ভাল বা উচিত প্রতিক্রিয়া বলছি না। অবশ্যই এগুলো জঘন্য অসভ্যতা। কিন্তু যেটা বোঝা যেত, লোকে খেপে আকুল হয়ে গেছে, হতাশা আর ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে পথঘাট সর্বত্র। কিন্তু মেয়েরা হেরে যাওয়ার পর কারও রাগ নেই কেন? মুখচোখ লাল হয়ে যাওয়ার বদলে সবার ঠোঁট মায়া, অনুকম্পায় যথাযথ থরথর কেন? কারণ, মেয়েরা হেরে গেলে আসলে কিছু এসে যায় না। মেয়েরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলে তা আমাদের মনে স্লাইট গর্ব আর হইহইয়ের সঞ্চার করত অবশ্যই, কিন্তু না হওয়ায় কণামাত্র এতোলবেতোল ঘটেনি। মেয়েদের ক্রিকেটের প্রতি আমাদের না আছে প্যাশন, না আছে সমীহ, একটা সস্নেহ প্রশ্রয় আছে মাত্র। ম্যাচ হারার পর টিভি বন্ধ করে দেওয়ার বদলে আমরা অন্য চ্যানেলে ফিল্মের গান দেখেছি, সকালে কাগজ পড়ে মিডিয়ার সুরে সুর মিলিয়ে চুকচুক করেছি, ইইস, বেচারা! ওরা কিন্তু খুব ভাল। আমার কিন্তু ভীষণ গর্ব হচ্ছে।

মেয়েদের প্রতি এই যে আহা সোনুমোনু অ্যাপ্রোচ, এটাই নারীকে (ও নারীবাদকে) সবচেয়ে অপমান করে। যদি আমরা মেয়েদের সমান ভাবতাম, তা হলে তাঁরা খারাপ খেললে তেড়ে গালাগাল দিতাম। টুইট করতাম: হতাশ করলে হে, অথবা, ধুত্তোর চোকার কোথাকার! এমন একটা ভাব দেখাতাম না যে রানার্স হয়েই তোমরা আমাদের উদ্ধার করেছ। পরাজিতকে আসলি চ্যাম্পিয়ন বলে মেলোড্রামার সুইচ অন করতাম না। খেলার রিপোর্ট করার সময়, সমালোচনার খোঁচাগুলো যথাসম্ভব প্রলেপ দিয়ে রেখেঢেকে, ‘আহা তাতে কিসের ক্ষত, এই করেছ এই না কত’ দরদে গলে পড়তাম না। এই গ্রেস দিয়ে দেখাটাই মেয়েদের সবচেয়ে ছোট করে। তাদের লড়াইকে হীন করে। সন্তান রেজাল্ট নিয়ে বাড়ি আসার পর যদি ‘আরে, অংকে তো আর একটু হলেই পাশ করে গেছিলি রে! বিরিয়ানি আন!’ বলি, তা তার ফেল করাকে চূড়ান্ত ঘা কষায়। ছেলেরা যা করলে আমরা যাচ্ছেতাই বলতাম, মেয়েরা তা করলে আমরা প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছি— এর মধ্যেই আছে সেই মানসিকতা: ছেলেরা যা পারে, তা মেয়েদের দ্বারা আসলে হয় না। ওরা দুধভাত।

সমান ভাবে দেখা খুব সহজ নয়। অনেক ওপর থেকে ভুরু কুঁচকে একটু ঝিঁক মেরে নজর করে, তার পর লোক-দেখানো সমান-সমান খেলতে গেলে, অনুগ্রহের সুরটা চট করে ধরা পড়ে যায়। মেয়েরা যদি সমান হয়, তবে তাদের দিকে স্ট্রেট সমান-চাউনি দাও, দাক্ষিণ্য নয়। যদি মেয়েদের ক্রিকেটকে মর্যাদা দিতে হয়, তবে তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে ফাউ ফুচকা দিয়ো না। মিডিয়া থেকে ভিআইপি, সাধারণ লোক থেকে কলরব হোক, সবাই যদি সিমপ্যাথির খোসায় ক্রমাগত হড়কে যাও, তা হলে বোঝা যাবে, আসলে মেয়েদের সমান ভাবছিলে না, বরং নিজেকে মহৎ ভাবার খেলায় নেমেছিলে। মেয়েদের কথা ভেবে মেয়েদের ধন্য করে দিচ্ছিলে।

এই এক্সট্রা হাততালি ও কৃপা-ল্যাবেঞ্চুস ছিটিয়ে নিজের পিঠ-চাপড়ানোর অভ্যাস আমাদের মজ্জায়। রিয়েলিটি শো-তে অন্ধ প্রতিযোগী ভাল গাইলে আমরা লাফাই, রাশি রাশি নম্বর দাও! আমরা যে দিন তাকে সেই নম্বর দিতে শিখব, ওই গান এক চক্ষুষ্মান ব্যক্তি গাইলে এগজ্যাক্টলি যত পেত, সে দিন তাকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাব। তাকে সমান মর্যাদা দেব। সে দিন তাকে ‘অন্ধ গায়ক’ না ভেবে, ‘গায়ক’ ভাবব। কেউ বলতে পারে, সে যে চক্ষুষ্মানের তুলনায় বেশি প্রতিকূলতা ঠেলে এল? সে জন্য তাকে বাহবা দেব, কিন্তু গানকে বেশি নম্বর দেব না, তা হলে তা তার গানকে ছোট করবে, তার কৃতির ঠিক মূল্যায়ন হবে না। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ কাকে বলে? যখন সেই আচরণ, মানুষটি নারী, স্রেফ এই জন্যই তাকে ছোট করে। যদি আমি নারীর প্রতি এমন আচরণ করি, যা, সে নারী, শুধু এই জন্যই তাকে বড় করে, তা-ও বৈষম্যমূলক। মেয়ে মাত্রেই বড্ড ভাল বলে চেঁচালে, তা নারীবাদের বিরোধিতাই, কারণ, মানুষটিকে মানুষ না ভেবে ‘মেয়ে’ ভাবা হল। তার কাজটা কী, তা তালির যোগ্য না দুয়োর যোগ্য, তা না দেখে, তার লিঙ্গ কী, সে দিকে চোখ ফেড়ে তাকিয়ে থাকা হল। এই উঁচাই-খেলার সুবিধে হল, অন্য ক্ষেত্রে সহজে নীচে দলে দেওয়া যায়। নারীকে সমান ভাবা মানে তাকে দেবী ভাবা নয়, কম্পালসরি অকলুষ ভাবা নয়, বরং জানা, তারও দোষ আছে, গুণ আছে, খুশকি ব্রণ মাহাত্ম্য নীচতা আছে, হুবহু পুরুষের মতোই। তার কোনও বাড়তি অপমান প্রাপ্য নয়, বাড়তি সম্মানও। সিনেমায় নেগেটিভ নারীচরিত্র দেখলেই যারা ‘হু-ই নারীবিদ্বেষ’ বলে আঙুল তুলে চিল্লায়, তারা নিজ গামবাটপনাকে জলদি প্রগতিশীলতায় চুবিয়ে ফাঁকি-ট্রফি তুলতে চায়। অবশ্য শিক্ষিত হতে ব্যস্ত থাকলে, ফেসবুকে ক্যাচি নারীবাদ ফলানো পোস্টগুলো করত কখন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE