Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

চিকিৎসকের সংকট

পশ্চিমবঙ্গেও বামফ্রন্ট আমলে এক বার তিন বৎসরের চিকিৎসক-প্রশিক্ষণ পাঠ্যক্রম শুরু হইয়াছিল, এক বার নার্সদের প্রশিক্ষণ দিয়া কয়েক ধরনের চিকিৎসার অধিকার দেওয়ার প্রশিক্ষণ শুরু হইয়াছিল।

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৩০
Share: Save:

দেশের চিকিৎসা সংকটের মোকাবিলায় একটি প্রস্তাব মাঝে মাঝেই শোনা গিয়াছে: আয়ুর্বেদ, হোমিয়োপ্যাথি প্রভৃতি বিকল্প ধারার চিকিৎসকদের মূলধারার পাশ্চাত্য চিকিৎসা করিবার অধিকার দেওয়া। সম্প্রতি ‘জাতীয় মেডিক্যাল কমিশন বিল ২০১৭’ তাহার প্রতিধ্বনি করিয়াছে। একটি ‘ব্রিজ কোর্স’ করাইয়া বিকল্প চিকিৎসকদের মূলধারায় আনিবার প্রস্তাব করা হইয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নূতন চিকিৎসা সংক্রান্ত বিলটিতে এই প্রস্তাব স্থান পাইয়াছে। আপাতত বিলটি শিকেয়, কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর সরকার কোনও উদ্যোগ সহজে ছাড়িবার পাত্র নহে। সত্য ইহাই যে, উপরোক্ত প্রস্তাবটি কার্যকর হইলে হিতে বিপরীত হইবে। চিকিৎসার এই বিভিন্ন ধারায় রোগের সংজ্ঞা, কারণ এবং নিরাময়, প্রতিটির ক্ষেত্রে তাহাদের দর্শন ও প্রকরণ ভিন্ন, এমনকী পরস্পর-বিরোধী। একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ্যক্রম কী করিয়া তাহাদের সেতুবন্ধন করিবে? একটি ধারায় চিকিৎসা করিতে হইলে অপর ধারাটির সত্যতা ও কার্যকারিতা খারিজ করিতে হইবে, ভুলিতে হইবে। তাহাতে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পদ্ধতি, সকলই বদলাইয়া যাইবে। সুপ্রিম কোর্টও বেশ কয়েকটি মামলায় ‘ক্রস প্র্যাকটিস’ অর্থাৎ এক ধারার চিকিৎসকের অপর ধারায় চিকিৎসার অভ্যাসকে অপরাধ বলিয়া রায় দিয়াছে। নূতন প্রস্তাব সেই পুরাতন ভ্রমের পথে হাঁটিতেছে।

পশ্চিমবঙ্গেও বামফ্রন্ট আমলে এক বার তিন বৎসরের চিকিৎসক-প্রশিক্ষণ পাঠ্যক্রম শুরু হইয়াছিল, এক বার নার্সদের প্রশিক্ষণ দিয়া কয়েক ধরনের চিকিৎসার অধিকার দেওয়ার প্রশিক্ষণ শুরু হইয়াছিল। চিকিৎসক সংগঠনগুলির প্রবল বাধায় কোনওটিই সম্পূর্ণ হতে পারে নাই। মূল ধারার চিকিৎসকেরা বরাবরই এমন ‘অর্ধ-শিক্ষিত’ ডাক্তার তৈরির নীতিকে দরিদ্র-বিরোধী বলিয়া চিহ্নিত করিয়াছেন। সেই কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু তাঁহাদের আত্মসমালোচনার প্রয়োজনও রহিয়াছে। চিকিৎসা সংকটের সমাধান খুঁজিতে চিকিৎসকরা বরাবর রাষ্ট্রের উপর দাবির পরিমাণ বাড়াইয়াছেন, এখনও তাহাই করিতেছেন। আরও মেডিক্যাল কলেজ, আরও শিক্ষক, আরও উন্নত পরিকাঠামো, এমন নানা দাবি তাঁহারা তুলিয়াছেন। হয়তো সেগুলি অসংগত নহে, কিন্তু তাঁহাদের নিজেদের কর্তব্যও কি তাঁহারা করিতেছেন?

শহরের ন্যায় উন্নত পরিকাঠামো গ্রামে সম্ভব নহে। অথচ গ্রামের পরিস্থিতি বুঝিয়াও তাঁহারা গ্রামে যাইবার জন্য, নবীন চিকিৎসকদের গ্রামে প্রেরণ করিবার জন্য, উদ্যোগী হন নাই কেন? কেন গ্রাম-ব্লক-জেলা সদরের হাসপাতাল হইতে রোগীকে অকারণে শহরে ‘রেফার’ করা হয়? কেবল পরিকাঠামোর দোহাই দিয়া চিকিৎসকেরা দায় এড়াইতে পারেন না। তাঁহাদের স্থান শূন্য রহিয়াছে বলিয়াই অ-চিকিৎসক দিয়া তাহা পূরণের উদ্যোগ। অপ্রশিক্ষিত চিকিৎসকদের বৈধতা দিবার প্রস্তাব উঠিলেই চিকিৎসক সংগঠনগুলি সরব হন। অপর সময়ে গ্রামীণ চিকিৎসা লইয়া তাঁহাদের কোনও হেলদোল দেখা যায় না। গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বাস্তবিক চিন্তিত হইলে চিকিৎসক সমাজকেও অন্য ভাবে চিন্তা করিতে হইবে। অ-চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা ডাক্তাররা কেন সহিতেছেন, কেন বিকল্প সমাধানের অনুসন্ধান করেন নাই, সে প্রশ্নটিও দেশ আজ করিবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Doctor Rural hospitals Doctors
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE