সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে চিকিৎসক ও সমাজকর্মী বিনায়ক সেন বলিয়াছেন, বৈষম্য প্রকাশ পায় অপুষ্টিতে। তাহাই দেখাইল এক জাতীয় সমীক্ষায়। দলিত ও আদিবাসী শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার অপরাপর শ্রেণির শিশুদের চাইতে অনেক বেশি। বিশেষত চরম অপুষ্টির যাহা লক্ষণ, বয়স অনুপাতে অনুচ্চতা (স্টান্টিং), তাহা দলিত শিশুদের মধ্যে প্রায় চল্লিশ শতাংশ, আদিবাসী শিশুদের চৌত্রিশ শতাংশ। অনাদিবাসী, অ-দলিতদের মধ্যে তাহা সাতাশ শতাংশ। হায়দরাবাদের একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের এই নমুনা সমীক্ষা তাহা আরও স্পষ্ট করে এই কারণে যে, এটি প্রত্যন্ত গ্রামের ছবি নহে। ষোলোটি রাজ্যের শহর এলাকায় বারো হাজার গৃহস্থালিতে গিয়াছিলেন গবেষকরা। দেখা গিয়াছে, যে সকল পরিবারের রোজগার কম, পিতার অক্ষরপরিচয় নাই এবং বাড়িতে শৌচাগার নাই, সেখানেই শিশুদের অপুষ্টি অধিক। ইহার অর্থ, শহরে আসিয়াও দলিত-আদিবাসী পরিবারগুলির জীবনযাত্রার মান বাড়ে নাই। উন্নত পরিকাঠামো ও পরিষেবা লইয়াও শহরগুলি বৈষম্যের আড়ত হইয়া রহিয়াছে। রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন, ধনের ধর্মই অসাম্য। দলিত শিশুদের দেহপটে সেই সত্যটি নিয়ত লেখা হইতেছে একবিংশের ভারতেও।
পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের কয়েক ডজন প্রকল্প লইয়াও রাষ্ট্র দলিত-আদিবাসী পরিবারের শিশুদের পুষ্টির সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ কেন? এই সমীক্ষা উত্তরের ইঙ্গিত দিয়াছে। টাকার অভাব বা খাদ্যের অভাবই অপুষ্টির একমাত্র কারণ নহে। তিন-চার বৎসরের শিশুর পুষ্টির জন্য যেটুকু খাবার প্রয়োজন, তাহা জোগাড় করা অনেক ক্ষেত্রেই দরিদ্র পরিবারেও সাধ্যাতীত নহে। কিন্তু পুষ্টি বিষয়ে অজ্ঞতা, পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অভাবে ঘন ঘন পেটের অসুখ, শিশুর তত্ত্বাবধানে অক্ষমতা, এমন অনেকগুলি বিষয় শিশুর পুষ্টিকে ব্যহত করে। শহরে দরিদ্র পরিবারগুলিতে প্রায়ই দেখা যায়, কর্মব্যস্ত মা শিশুকে কিছু মুড়ি কিংবা একটি বিস্কুট দিয়া বসাইয়া রাখেন। গ্রামে আজও শিশুকে মুড়ি খাইতে দেওয়া হয় মেঝেতে ছড়াইয়া, যাহাতে সে অনেকক্ষণ খুঁটিয়া খায়। পুষ্টিবিধানের শিক্ষা দিবার কথা ছিল অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির। কিন্তু সেগুলি খিচুড়ি বিতরণের কেন্দ্র হইয়াই রহিয়াছে। যদিও পুষ্টিকর খাবারের চাইতে পুষ্টিবিধানের শিক্ষা যে অধিক প্রয়োজন, তাহা বারবার সকল সমীক্ষাতে প্রমাণিত হইতেছে। ভুলিলে চলিবে না, বিশ্বের যে দেশগুলিতে মাথাপিছু রোজগার ভারতের চাইতে অনেক কম, সেখানেও শিশুরা ভারতের শিশুদের চাহিতে অধিক পুষ্ট।
অতএব খাদ্যসুরক্ষা শিশুপুষ্টির একটি দিক মাত্র, একমাত্র নহে, সেই সত্যকে স্বীকার করিতে হইবে। বহু বৎসর ধরিয়া দরিদ্র পরিবারগুলিকে ভর্তুকিতে চাল-গম দিয়াও অনূর্ধ্ব-পাঁচ বৎসরের শিশুদের পুষ্টি কমে নাই, তাহা এত দিনে প্রতিষ্ঠিত। অতএব প্রয়োজন দরিদ্র শিশুর সার্বিক সুরক্ষা ও তত্ত্বাবধান। শহরে দরিদ্র মায়েরা কাজ করিবেই। শিশুদের দেখাশোনায় সহায়তা করিতে হইবে সমাজকে। তামিলনাড়ুতে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি ‘ক্রেশ’-এর মতো সারা দিন দরিদ্র শিশুদের দেখাশোনা করিয়া থাকে। তাহাতে পুষ্টি, শিক্ষা, মেধার বিকাশ, সকলই হওয়া সম্ভব। তেমনই, শৌচাগার বানাইয়া ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর ধ্বজা উড়িতে পারে। কিন্তু নিকাশি ব্যবস্থা ও আবর্জনা সরাইবার ব্যবস্থা কার্যকর না হইলে শিশুদের বার বার উদরাময় ও তজ্জনিত অপুষ্টি হইতে বাধ্য। সর্বোপরি, শিশুপুষ্টির জন্য স্তন্যপান আবশ্যক। প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা আশি শতাংশেরও অধিক শিশুকে সেই সুরক্ষা দিতে পারিয়াছে, অথচ ভারতে প্রায় অর্ধেক শিশু আজও তাহাতে বঞ্চিত। দরিদ্র শিশুর দেহ ও মেধার বিকাশ অসুরক্ষিত রাখিয়া ভারত অনুন্নয়নকে দীর্ঘ ও গভীর করিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy