Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

আধিপত্য

রাজনৈতিক কারণ অবশ্য বিলক্ষণ আছে। কমিটিতে দলের লোক ঢুকাইয়া স্কুলগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা আধিপত্য কায়েমের অত্যন্ত পরিচিত পদ্ধতি।

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

পার্থ চট্টোপাধ্যায় থামেন নাই। প্রেসিডেন্সি-যাদবপুর লইয়া আগ্রহ কমিয়াছে কী কমে নাই, তিনি সরকার-পোষিত স্কুলগুলির কথা ভাবিতে আরম্ভ করিয়াছেন। অতঃপর, পরিচালনা কমিটির ডানা ছাঁটিবার উদ্যোগ। সাদা চোখে দেখিলে, কাজটি মন্দ নহে। একটি স্কুল চালাইবার জন্য আদৌ কেন পরিচালনা কমিটির প্রয়োজন হইবে, সেই প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত। রাজনৈতিক কারণ অবশ্য বিলক্ষণ আছে। কমিটিতে দলের লোক ঢুকাইয়া স্কুলগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা আধিপত্য কায়েমের অত্যন্ত পরিচিত পদ্ধতি। কাজেই, সেই ঘোগের বাসা ভাঙিলে মন্দ কী? কিন্তু, অনুমান করা চলে, স্কুল হইতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কমানো শিক্ষামন্ত্রী মহাশয়ের উদ্দেশ্য নহে। কেন পরিচালনা কমিটির ডানা ছাঁটিবার উপক্রম হইয়াছে, তাহার দুইটি সম্ভাব্য কারণের দিকে নির্দেশ করা চলে। এক, কমিটির ঘুরপথে নিয়ন্ত্রণকে তিনি যথেষ্ট বোধ করিতেছেন না— দলের নাম তো আর সিপিআইএম নহে যে স্কুল কমিটিও আলিমুদ্দিনের নির্দেশের বাহিরে নিঃশ্বাসটুকুও ফেলিবে না, তৃণমূলের গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠীর হরেক সমীকরণে নিয়ন্ত্রণ শিথিল হইয়া যাইতেই পারে; দুই, এখনও কিছু স্কুলের কমিটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের দখলে থাকিয়া যাওয়ায় শাসক দলের আধিপত্য নিষ্কণ্টক হইতেছে না। কারণ যাহাই হউক না কেন, স্কুল কমিটির ডানা না ছাঁটিয়া এই গোলমেলে বস্তুটিকে সম্পূর্ণ উঠাইয়া দিয়া প্রধান শিক্ষকের উপর দায়িত্ব ন্যস্ত করিলেই চলিত। স্কুল চালাইবার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তো প্রধান শিক্ষকের হাতে থাকাই বিধেয়। কিন্তু, তাহা হইবার নহে। কারণ, পার্থবাবু নিজের অভ্যাস অনুসারে বলিতেই পারেন, ‘টাকা যখন দিই, তখন নিয়ন্ত্রণও করিব।’

সেই নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা পাকা করিবার সব উপাদানই স্কুলশিক্ষা দফতরের খসড়া বিজ্ঞপ্তিতে রহিয়াছে। কোনও কারণ না দর্শাইয়াই সরকার-পোষিত স্কুলের পরিচালন সমিতির প্রধান ও অন্য দুই মনোনীত সদস্যকে সরাইয়া দেওয়ার অধিকার হইতে শিক্ষক নিয়োগ, সব ক্ষমতাই মধ্যশিক্ষা পর্ষদের হাতে যাইতেছে। অর্থাৎ, বকলমে পার্থবাবুর হাতে। প্রধান শিক্ষক মহাশয়ও যে সেই নিয়ন্ত্রণের আঁচ সামলাইতে পারিবেন না, তাহা অনুমান করা চলে। অর্থাৎ, পরিচালন কমিটির আবডালটুকুরও আর প্রয়োজন থাকিল না, অতঃপর বিকাশ ভবন হইতেই স্কুল চলিবে। অনিল বিশ্বাসের সহিত পার্থ চট্টোপাধ্যায়দের এই ফারাকটি বোধহয় ঘুচিবার নহে। আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকেও যে শিল্পের স্তরে উত্তীর্ণ করা যায়, কোনও ধোঁকার টাটি না ভাঙিয়াও যে গোটা রাজ্যকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের দেরাজে বন্ধ করিয়া ফেলা চলে, অনিল বিশ্বাস তাহা দেখাইয়াছিলেন। পার্থবাবুদের সব কিছুই বড় বেশি মোটা দাগের।

তিনি অবশ্য রাখঢাকের পরোয়াও করেন নাই। শিক্ষামন্ত্রী হওয়া ইস্তক তিনি বিশ্বাস করিয়াছেন এবং সেই বিশ্বাসকে ফলাও করিয়া বলিয়াছেন যে তিনি যেহেতু টাকা দেন, অতএব রাজ্যের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাঁহার তাঁবে থাকিতে বাধ্য। টাকাগুলি যে তাঁহার ব্যক্তিগত বা দলগত নহে, তাঁহারা রাজকোষের টাকার মালিক নহেন, অছিমাত্র— এই কথাগুলি পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে স্মরণ করাইয়া দেওয়া অর্থহীন। তিনি সম্ভবত বুঝিবেন না বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন। এবং, সেই না বুঝিবার ফলেই তিনি একটি যথার্থ সিদ্ধান্ত লইবার ক্ষেত্রেও মাত্র অর্ধেক পথ গিয়া ভুল রাস্তায় বাঁকিয়া গেলেন। স্কুলগুলি হইতে পরিচালনা কমিটির অনর্থক নিয়ন্ত্রণ লাঘব করা প্রয়োজন, কিন্তু তাহার পরিবর্তে শিক্ষা দফতরের অধিকতর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নাই। বরং, প্রধান শিক্ষকদের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা ছাড়িলে স্কুলগুলি পূর্বের তুলনায় কতখানি ভাল চলিতে পারে, তাহা দেখাই উচিত ছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

School headmaster Partha Chatterjee power
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE