বি জ্ঞান গবেষণার প্রতিযোগিতায় প্রাচ্য বহুযুগ পূর্বে পাশ্চাত্যের নিকট পরাস্ত। বিজ্ঞানের কোনও শাখাতেই চমকপ্রদ সাফল্য প্রাচ্যের গবেষণাগারগুলিতে অর্জিত হয় না। নোবেল পুরস্কারের তালিকায় দৃষ্টিপাতই যথেষ্ট। পদার্থবিদ্যায় দুই সর্বশেষ সাফল্য হিগ্স বোসন ওরফে ঈশ্বরকণার সন্ধান ও আলবার্ট আইনস্টাইন-কল্পিত মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তকরণ। দুই সাফল্যই মিলিয়াছে পাশ্চাত্যের গবেষণাগারে। জেনিভার নিকটস্থ সার্ন-এ হদিশ মিলিয়াছে ঈশ্বরকণার, আমেরিকায় হ্যানফোর্ড ও লিভিংস্টোনের দুই গবেষণাগার সন্ধান দিয়াছে মহাকর্ষ তরঙ্গের। প্রথম সাফল্যের জন্য নোবেল ইতোমধ্যে ঘোষিত, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রেও প্রত্যাশিত। ওই দুই সাফল্য যে যে গবেষণায়, তাহাতে প্রাচ্যের বিজ্ঞানীরা যুক্ত ছিলেন বটে, কিন্তু নেতৃত্ব দিতে নহে, বরং পাশ্চাত্যের গবেষকদিগকে অনুসরণ করিতে। প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে অনুসরণ স্বল্পমূল্যের বিবেচিত হয়।
ভারতের কথা ধরা যাউক। এই দেশ হইতে পশ্চিমে মগজ-চালান বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে এক বৃহৎ সমস্যা। পাশ্চাত্যে গবেষণারত ভারতীয় বিজ্ঞানীরা যে প্রায়শ সফল হন, এমনকী নোবেল পুরস্কারও লাভ করেন, তাহার উদাহরণও আছে। কিন্তু স্বদেশে গবেষণা করিয়া তাঁহারা খ্যাতির শিখরে আরোহণ করিতে পারেন না। এই সম্ভাবনা হইতে পরিত্রাণের আশায় তাঁহারা পশ্চিমে পাড়ি দেন। মগজ-চালান রোধের নিমিত্ত স্বদেশে গবেষণার সুযোগবৃদ্ধি জরুরি। ওই লক্ষ্যে পদার্থবিদ্যায় অগ্রগণ্য দুই গবেষণায় ভারতীয় বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে শামিল হইবেন। বিচিত্র কণা নিউট্রিনো-র চরিত্র অনুধাবন এবং মহাকর্ষ তরঙ্গ-সম্পর্কিত পরীক্ষা। দুই গবেষণাতেই হাজার কোটি টাকার ঊর্ধ্বে ব্যয় হইবে। অথচ, প্রথম গবেষণায় ভারতীয় বিজ্ঞানীরা স্বাধীন ভাবে নামিতেছেন পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের অনেক পরে, আর দ্বিতীয় গবেষণাও তো আবার একক ভাবে নহে, পাশ্চাত্যের গবেষকদের সহযোগী হিসাবে।
অনুসরণ কিংবা সহযোগের এই ধারা বুঝি এই বার কিঞ্চিদধিক পাল্টাইবে। এই লক্ষ্যে এক বড় ভূমিকায় অবতীর্ণ হইতেছে চিন। জীববিজ্ঞানে যেই সব পরীক্ষানিরীক্ষা পশুর— বিশেষত বানর শ্রেণির জীবের— উপর করিতে হয়, সেই সব গবেষণার মক্কা হইয়া উঠিতেছে ওই দেশ। আমেরিকা ও ইউরোপের গবেষকেরা স্বদেশের ল্যাবরেটরি পরিত্যাগ করিয়া এখন চিন-এ পাড়ি দিতেছেন। পরীক্ষাদির প্রশস্ততর পরিবেশের লোভে। মগজ-চালানের সমস্যা ভারতে যেমন, চিনেও তেমন। তবে পশ্চিমী বিজ্ঞানীদের চিনাভিমুখী যাত্রার এই উলটপুরাণ সম্ভব হইতেছে কী কারণে? সে অন্য কাহিনি। জীবকুলে বানর মানুষের নিকটবর্তী। বহু রোগের মডেল বা ঔষধের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া আগাম অনুধাবনে বানর শ্রেণির জীবের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা জরুরি। কিন্তু পাশ্চাত্যে ইদানীং পরীক্ষার নামে পশুর উপর মানুষের অত্যাচার অনেকের না-পসন্দ। রাজনীতিবিদরাও পশুপ্রেমীদের সমর্থক। ফলত, জীববিজ্ঞানের বহু গবেষণা হয় ব্যাহত, নয় স্তব্ধ। চিনে পশুপ্রেমীরা হয় নীরব, নয় একদলীয় সরকার সেই প্রেমের তোয়াক্কা করেন না। ওই দেশে পশুর উপর পরীক্ষার অবাধ সুযোগ। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীগণ তাই চিনমুখী। গবেষণায় প্রাচ্যের এই জয় কিন্তু এক বড় প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করায়। নীতিচিন্তা বনাম গবেষণা। দুইয়ের মধ্যে কে বড়? অথবা, কোন রাষ্ট্রব্যবস্থা বিজ্ঞান গবেষণার সহায়ক: একনায়কতন্ত্র না গণতন্ত্র?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy