হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদ লইয়া এনআইএ-র সাম্প্রতিক রায়টি অনেকেরই ভ্রুকুঞ্চনের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এনআইএ-র বিশেষ আদালত এই মামলায় অভিযুক্ত পাঁচ জনকেই নির্দোষ ঘোষণা করিয়াছে, কেননা তাঁহাদের বিরুদ্ধে ‘যথেষ্ট প্রমাণ’ নাই। অবশ্যই, ‘প্রমাণের অভাব’ বিষয়টি এ ক্ষেত্রে বোধগম্য ও সন্দেহোর্ধ্ব নহে। তেলঙ্গানারই বিভিন্ন আইনজীবী সংগঠন প্রশ্ন তুলিয়াছে, এতগুলি সুস্পষ্ট অভিযোগ ও তাহার সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশের পরও কী ভাবে ‘প্রমাণাভাব’ প্রতিষ্ঠিত হইল। অভিযুক্তরা আগে যে বয়ান দিয়াছেন, সেই বয়ান পুলিশই নাকি চাপ দিয়া লিখাইয়া লইয়াছে— অভিযুক্তদের পরবর্তী সময়ের বক্তব্য। আদালত ঠিক কোন যুক্তিতে এই বক্তব্য গ্রহণ করিতে রাজি হইল, তাহা স্পষ্ট নয়। যেমন স্পষ্ট নয়, কেন এক জন অনভিজ্ঞ আইনজীবীকে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সরকারি পক্ষের কৌঁসুলি হিসাবে দাঁড় করানো হইয়াছিল। বিচারের রায় অনেক সময় বিচারের প্রক্রিয়ার ফলেও সংশয়-উৎপাদক হইয়া পড়ে। এ ক্ষেত্রেও উল্লেখ্য, রায় প্রকাশের অব্যবহিত পরই বিচারক রবীন্দ্র রেড্ডির পদত্যাগপত্র জমা দিবার ঘটনাটি। ঘটনাটিকে ঠিক সাধারণ বলা চলে না। বিচারক রেড্ডির অবসর গ্রহণের যখন কয়েক মাস মাত্র বাকি, এমন এক সময়ে কেন তাঁহাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় প্রকাশের দিনই পদত্যাগপত্র দিতে হইল? তবে কি তাঁহার উপর বিশেষ কোনও চাপ ছিল? তাঁহার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয় নাই, সুতরাং প্রশ্ন আরওই উঠিতে পারে: তবে কি তাঁহার নিজের বিবেচনা ও আদালতের একাংশের বিবেচনা মিলিতে ছিল না বলিয়াই তাঁহার এই পদক্ষেপ? বাস্তবিক, এই সব প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য বাহিরের লোক লাগে নাই। মক্কা মসজিদ মামলা বিষয়ে এনআইএ-র কার্যপদ্ধতি লইয়া এনআইএ-র মধ্য হইতেই বিস্ময় ও অস্বস্তির স্বর ধ্বনিত হইয়াছে।
বিস্ময় ও অস্বস্তি স্বাভাবিক, কেননা আশ্চর্য ভাবে গত বৎসর মার্চ মাসে এই মামলার প্রধান তদন্তকারী এনআইএ-ভুক্ত পুলিশ অফিসার প্রতিভা অম্বেডকরকে মামলা হইতে সরাইয়া দেওয়া হয়। তাঁহাকে নাকি এখনই উত্তরপ্রদেশে প্রয়োজন, এই যুক্তি দিয়া হায়দরাবাদের এই মামলা হইতে অকস্মাৎ তাঁহাকে তুলিয়া লওয়া হয়। অথচ তখনও পর্যন্ত মক্কা মামলাই তাঁহার প্রধান কর্মবিন্দু। সংশয়ের পারদ আরও চড়িয়া যায় যখন প্রতিভার স্থানান্তরণের প্রায় একই সময়ে প্রধান দুই অভিযুক্ত স্বামী অসীমানন্দ ও ভারত মোহনলাল জামিনে ছাড়া পান, এবং এনআইএ সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করিতেও অগ্রসর হয় না। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে এই ঘটনা ঘটিবার সময় কেবল এনআইএ নহে, সমতুল্য অন্য তদন্ত এজেন্সিগুলিও কিন্তু বিষয়টি লইয়া কানাঘুষো আলোচনা শুরু করিয়াছিল।
অন্যান্য সমতুল্য তদন্ত সংগঠন হইতে এনআইএ-র বিশেষত্ব এইখানে যে তাহারা অন্তর্দেশীয় নিরাপত্তার বিষয়টি দেখাশোনা করে, এবং প্রধানত উগ্রপন্থী আক্রমণের মোকাবিলায় নিযুক্ত হয়। আদালতের কর্মকাণ্ড নিশ্চয়ই সর্বদা সাধারণের বোধগম্য হইবার কথা নয়, কিন্তু তবুও নাগরিকের চোখে যদি এমন একটি সংগঠন নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাইয়া ফেলে, সে ক্ষেত্রে অন্তর্দেশীয় নিরাপত্তার মতো গুরুতর বিষয় লইয়া তদন্তের অধিকারও তাহার থাকে না। সম্প্রতিকালে হাদিয়া মামলায় ‘লাভ জেহাদ’ নামক কল্পিত অপরাধের সন্ধানে এনআইএ-কে কাজে লাগানো যতটা রাজনৈতিক অভিসন্ধিপূর্ণ বলিয়া সন্দেহ, মক্কা মসজিদ মামলাতেও সেই সন্দেহ ফিরিয়া আসিতেছে। কেবল দুর্ভাগ্য-দ্যোতক নয়, ঘটনাটি প্রবল উদ্বেগজনক। দেশের নিরাপত্তার ভার যদি নিরাপদ ও নিরপেক্ষ হাতে না থাকে, তাহার অপেক্ষা বড় উদ্বেগ আর কী হইতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy