Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

সাধ না মিটিল

বাস্তবিক, দেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অনশনে বসিবার এই তো যথার্থ সময়। আট বৎসরের বালিকাকে লাগাতার ধর্ষণ করিয়া খুন করা হইতেছে, তাঁহার দলের নেতা-বিধায়করা ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল বাহির করিতেছেন।

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৫৪
Share: Save:

টাকার উপর নিজের ছবি ছাপাইয়া ফেলাটুকুই বাকি থাকিল। নচেৎ, নরেন্দ্র মোদী তো গাঁধী হইয়াই গিয়াছেন! সাবরমতী আশ্রমে বসিয়া চরকা কাটিয়াছেন। এই বার অনশনও করিয়া ফেলিলেন। মহাত্মা হইতে আর কী চাই? সংসদের বাজেট অধিবেশন সম্পূর্ণ নষ্ট হইয়া যাইবার প্রতিবাদে তিনি অনশন করিলেন। হতভাগ্য তিনি, বিরোধীরা তাঁহাকে সংসদে আলোচনা চালাইবার সুযোগই দেন নাই। বিরোধীরা যদি তাঁহাকে মহৎ হইতে না দেন, তিনি কী করিবেন? একটিই পথ: অনশন করিয়া সেই সংবাদটি দেশবাসীকে জানাইয়া দিবেন। ভক্তদের বুঝাইবেন যে কংগ্রেসের অনশনটি নেহাতই লোকদেখানো ছিল। কেহ কেহ প্রশ্ন করিতেছেন, রাহুল গাঁধী অনশন করিয়াছেন বলিয়াই কি নরেন্দ্র মোদীর অনশন? নরেন্দ্র মোদী ঈষৎ হাসিয়া বুদ্ধদেববাবুর ভঙ্গিতে বলিতে পারেন, কোথায় ২৭৪, আর কোথায় ৪৮! রাহুল গাঁধীর অনশন ছিল দলিতদের উপর সন্ত্রাসের প্রতিবাদে। ভারতে দলিত রাজনীতির বৃহত্তম প্রতীক ভীমরাও অম্বেডকরকে বিজেপি আপন করিয়া লইয়াছে— তাঁহার জন্মদিনে কর্মীরা মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধিয়া ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করিয়াছেন। বিজেপির বিরুদ্ধে ইহার পরও কি দলিতদের কোনও ক্ষোভ থাকিতে পারে? তাঁহাদের বিরুদ্ধে কি সরকার বা প্রশাসন বা সমাজ আর কোনও অন্যায় করিতে পারে? রাহুলের অনশনটি যে নেহাত অনর্থক ছিল, তাহা কি আর বলিয়া দিতে হয়? মোদীর অনশনের তাৎপর্য আরও গভীর ও ব্যাপক।

বাস্তবিক, দেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অনশনে বসিবার এই তো যথার্থ সময়। আট বৎসরের বালিকাকে লাগাতার ধর্ষণ করিয়া খুন করা হইতেছে, তাঁহার দলের নেতা-বিধায়করা ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল বাহির করিতেছেন। অন্য এক ধর্ষিতার পিতা আচমকা পুলিশ হেফাজতে মারা যাইতেছেন আর পুলিশ অভিযুক্ত মন্ত্রীর দিকে ফিরিয়াই চাহিতেছে না। রামনবমীর অজুহাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিতেছে, কাবেরীর জলের প্রশ্নে তামিলনাড়ু কেন্দ্রের বিরুদ্ধে উত্তাল হইতেছে। সব সমস্যার সমাধানকল্পে এখনই তো অনশনে বসিবার কথা! তাহাতেই সুবিধা— আলাদা করিয়া বিভিন্ন সঙ্কটের কথা ভাবিতে হয় না, দেশবাসী বুঝিয়া লন, তাঁহাদের প্রধানমন্ত্রী অসহায় বটে, কিন্তু অন্যায়গুলিকে তিনি কিছুতেই মানিয়া লইতেছেন না। মানিবেন কী করিয়া, এই প্রধানমন্ত্রীর ‘কৃতিত্ব’ তো জনগণ জানেন! মহম্মদ আখলাকের হত্যাকারীদের ‘শাস্তি’, গৌরী লঙ্কেশের আততায়ীর ‘বিচার’-এর মতো আসিফা বানুর ধর্ষক-খুনিদেরও প্রধানমন্ত্রী সেই কাল্পনিক শাস্তির মুখেই ফেলিবেন, জনগণ জানেন। গোসন্ত্রাসীদের যেমন তিনি ‘নিয়ন্ত্রণ’ করিয়াছেন, তেমনই দলের বেপরোয়া ধর্ষণ-সমর্থক নেতা-মন্ত্রীদেরও লাগাম তিনি টানিয়া ধরিবেন। এই প্রধানমন্ত্রী মানুষের আস্থাভাজন হইবেন না তো কে হইবেন? আর কে-ই বা অনশনে বসিবার নৈতিক উচ্চতা দাবি করিবেন?

প্রধানমন্ত্রী মোদীর সম্ভবত আশা ছিল, তাঁহার অনশন অন্তত একটি কাজ করিবে, গণমাধ্যমের নজরকে এই অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলি হইতে সরাইয়া দিবে। সর্বভারতীয় টেলিভিশনের পর্দায় শুধু থাকিবে তাঁহার অনশনক্লিষ্ট মুখ, সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় পাতায় আলোচনা চলিবে তাঁহার অনশনের যৌক্তিকতা লইয়া। যেমন ভাবে নোটবাতিলের ফলে ‘ভাতে মার খাওয়া’ ঠিকা শ্রমিকরা বিস্মৃত হইয়াছেন, যেমন ভাবে নীরব মোদীর প্রসঙ্গও ধীরে ধীরে মিলাইয়া গিয়াছে, আসিফা বানুও তেমন ভাবেই ঢাকা পড়িয়া যাইবে প্রধানমন্ত্রীর অনশনের দ্যুতিতে। তবে, পরিস্থিতি বলিতেছে, এই প্রথম বার তাঁহার হিসাব মিলিল না। তাঁহার অনশন অকিঞ্চিৎকর হাস্যকৌতুকের অধিক গুরুত্ব পায় নাই। দেশের গণমাধ্যম তথা জনগণের হাবভাব কি ঈষৎ বদলাইতেছে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi Hunger Strike
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE