মিস মার্গারেট নোবল লন্ডনে যে বাড়িটিতে থাকিতেন সেই বাড়িটিতে স্মারক উৎকীর্ণ করা হইয়াছে। ভারতবাসী এই ‘প্লাক’ বা স্মারক-ফলক লাগানোর ঘোষণায় আনন্দিত। স্বাভাবিক। মার্গারেট নোবলকে ভারতবাসী ভগিনী নিবেদিতা নামে জানেন। ভারতীয়দের হিতার্থে ভগিনী বহু কিছু করিয়াছিলেন। মানব ইতিহাসের পরম্পরায় হিতবাদী ঐতিহ্যের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ভগিনী নিবেদিতার জীবন সেই ঐতিহ্যের বরণীয় স্মারক। অতীত-কীর্তিকে স্মরণ করিবার কারণ ও প্রয়োজন, দুইই রহিয়াছে। অতীতের বিশেষ স্থাপত্য ‘অবিকল’ রক্ষার প্রচেষ্টা নানা দেশের সরকার করিয়া থাকে। উদাহরণ ভারতবর্ষ। ভারতভূমিতে নানা সভ্যতার আগমন ঘটিয়াছিল। নানা সভ্যতার স্থাপত্যের নানা রীতি। বিবিধ স্থাপত্য ও সৌধ আজও এই দেশে বিরাজমান। শিল্পকীর্তি হিসাবে তাহারা অনেকেই অতুলনীয়। তাহাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সরকার পুরাতত্ত্ব-বিভাগকে প্রদান করিয়াছেন। পুরাতন স্থাপত্য ও সৌধ রক্ষায় ভারতের চাহিতে অবশ্য পাশ্চাত্যের দেশগুলি অনেক অগ্রসর। সৌধ ছাড়াও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বসবাস-গৃহও ঐতিহ্যের আওতায় পড়ে। উনিশ-বিশ শতকের কলিকাতা শহরে নানা বিশিষ্ট জনের বসবাস ছিল। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র— নানা ক্ষেত্রে কৃতী এই মানুষদের বাসগৃহগুলিকে এই রাজ্যে আলাদা করে চিহ্নিত করা হইয়াছে। পূর্বের চেহারা-চরিত্র যেখানে রক্ষা করা সম্ভব সেখানে রক্ষা করা বিধেয়, যেখানে তাহা করা যায় নাই সেখানে নতুন চেহারা প্রদান করা হইয়াছে। বোসপাড়া লেনে যে বাড়িটিতে ভগিনী নিবেদিতা তাঁহার বিদ্যালয় চালাইতেন তাহা নানা ভাবে সজ্জিত করিবার উদ্যোগ সাম্প্রতিক কালে হইয়াছে। ইংল্যন্ডেও হইল।
ফলক লাগানো বা ‘ঐতিহ্য’ ঘোষণা কিন্তু যথেষ্ট নহে। অতীতের কীর্তিকে যদি বর্তমানে সজীব করিয়া তুলিতে হয় তাহা হইলে স্মৃতির সহিত বর্তমান জীবনযাত্রার যোগ সাধন করিতে হইবে। যেখানে স্মৃতি কেবলমাত্র চিহ্নিত সজ্জিত স্মৃতি, সেখানে তাহার কিন্তু সহিত বর্তমান জীবনের যোগ সাধিত হয় না। যোগ সাধনের জন্য অধিকতর উদ্যোগ চাই। যেমন বোসপাড়া লেনের যে গৃহটিতে নিবেদিতা তাঁহার বিদ্যালয় চালাইতেন, সেই গৃহে যদি একালে পশ্চাৎপদ বালকবালিকার শিক্ষাবিস্তারে নিয়োজিত কর্মীরা মাঝে মাঝে আলোচনায় বসেন, তাহা হইলে অতীত সজীব হইয়া উঠিতে পারে। সাম্প্রতিক ভারতে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতা প্রবল হইয়া উঠিতেছে। এই সাম্প্রদায়িকতার জিগির যখন উঠে নাই তখনও তো ধর্ম-সম্বন্ধে সহনশীল প্রগতিবাদীরা কখনও ফতেপুর সিক্রিকে কেন্দ্র করিয়া সর্বধর্মসমন্বয়ী কোনও আলোচনার ব্যবস্থা করেন নাই! ফতেপুর সিক্রির ইবাদতখানায় আকবর যে ধর্মসমন্বয়ী সভার আয়োজন করিয়াছিলেন তাহা আমরা ভুলিয়াছি। ফলে ইসলামকে হিন্দুবিদ্বেষী হানাদার বলিয়া একদল সহজে দাগাইয়া দিতে তৎপর। ফতেপুর সিক্রির ঐতিহ্য, ইতিহাস জনজীবনে সঞ্চারিত হয় নাই। যদি তাহাই না হইল, ঐতিহ্যরক্ষার প্রাসঙ্গিকতা তবে কোথায়? নিবেদিতা তাঁহার ‘ওয়েব অব ইন্ডিয়ান লাইফ’ গ্রন্থে দেশের ইতিহাসকে জনজীবনের মধ্যে পাঠ করিতে চাহিয়াছিলেন। আমাদেরও কর্তব্য নিবেদিতার সেবা ও শিক্ষাদর্শকে জনজীবনের সজীবতায় স্থাপন করা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy