Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

ভ্রান্তিবিলাস

অশিক্ষিত জনতার হাতে স্মার্টফোনই অবান্তর হইহল্লার উৎস। ভারতের ‘নেটিজেন’রা কথাটি আরও এক বার প্রমাণ করিলেন। তাঁহারা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম স্ন্যাপডিলকে কষিয়া গালি দিলেন।

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৪০
Share: Save:

অশিক্ষিত জনতার হাতে স্মার্টফোনই অবান্তর হইহল্লার উৎস। ভারতের ‘নেটিজেন’রা কথাটি আরও এক বার প্রমাণ করিলেন। তাঁহারা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম স্ন্যাপডিলকে কষিয়া গালি দিলেন। ‘অপরাধ’: ভারতকে মূলত দরিদ্র দেশ বলা। ‘অপরাধী’: স্ন্যাপচ্যাট নামক সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সিইও! যে দেশ সত্যই দরিদ্র, তাহাকে দরিদ্র বলিলে অপরাধ হয় কি না, ভারতীয় নেটিজেনদের এই প্রশ্ন করা অবান্তর। কিন্তু, সেই অপরাধের বিচার করিবার পূর্বে, শাস্তিবিধানের পূর্বে স্ন্যাপচ্যাট ও স্ন্যাপডিলের মধ্যে ফারাকটি যে অন্তত বুঝিতে হয়, তাহাও কি ভারতের অনলাইন যোদ্ধারা মানিবেন? ‘গোলাপকে যে নামেই ডাকা হউক’ ইত্যাদি বলিয়া এই ভ্রান্তি ঢাকা দেওয়া মুশকিল। সম্পূর্ণ ঘটনাটি এক অশিক্ষার ফল। প্রথাগত শিক্ষার মাপকাঠিতে এই সাইবার-আর্মিকে অশিক্ষিত বলা চলিবে না— স্মার্টফোন এখনও সেই অর্থে শিক্ষিতদেরই ভোগ্য। ইহা প্রকৃত অশিক্ষা, যাহা আত্মসংযম শিখায় না। কোনও ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাইবার পূর্বে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করা, প্রতিক্রিয়াটির যাথার্থ্য ভাবিয়া দেখিবার মধ্যে যে আত্মসংযম, ভারতের সাইবার যোদ্ধাদের তাহা নাই। মনে রাগ আছে, হাতে স্মার্টফোন আছে, অতএব প্রতিক্রিয়া জানাইতে আর অপেক্ষা কেন— এই দর্শনটি ভারতে ক্রমে সর্বজনীন হইতেছে।

সহজলভ্য ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অবাধ মতপ্রকাশের অধিকার— একবিংশ শতকের এই যুগ্ম-আশীর্বাদ গণতন্ত্রের পক্ষে যুগান্তকারী হইতে পারিত। তাহা রাষ্ট্রবাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হইয়া উঠিয়াছে। পূর্বে কেবল রাষ্ট্র বিরুদ্ধ মতের কণ্ঠ রোধ করিতে চাহিত। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীও সেই কাজটি করিবার স্বাধীনতা পাইয়াছে। আমির খান হইতে গুরমেহের কৌর, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিন্নসুর গাহিয়া ‘ট্রোলড’ হইয়াছেন, এমন উদাহরণের সংখ্যা এখন অগুনতি। ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতি যাহা ভাবাইতে চাহে, তাহা ব্যতীত কেহ অন্য কথা ভাবিবার দুঃসাহস করিলেই সাইবার সেনারা তাঁহাকে সমঝাইয়া দেন। প্রতিক্রিয়াটি কতখানি স্বতঃস্ফূর্ত, আর কতখানি অত্যন্ত সংগঠিত পথে নির্মিত, সেই মীমাংসা সহজে হইবে না। কিন্তু, ভিন্নমতকে অপমান করিবার এই সামাজিক প্রবণতাটি ভয়ংকর।

ক্ষুদ্র রাজনীতির বাহিরেও এই ‘ট্রোলিং’-এর একটি বৃহত্তর পরিসর রহিয়াছে— উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিসর। অশিক্ষিত যুক্তিতে কোনও কথা ‘ভারতের পক্ষে অপমানজনক’ ঠেকিলেই পাল্টা অপমান করিতে ঝাঁপাইয়া পড়িবার অভ্যাসটি পাকাপাকি রকম তৈরি হইয়া গিয়াছে। প্রথমত, রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করা এবং দেশকে অপমান করিবার মধ্যে যে ফারাক আছে, তাহা বিস্মৃত হওয়া বিপজ্জনক। দ্বিতীয়ত, সমালোচনা ও অপমান এক কথা নহে। তৃতীয়ত, ভারতকে প্রশ্ন করিবার জন্য অথবা ভারতের সমালোচনা করিবার জন্য ভারতীয় হওয়ার কোনও প্রয়োজন নাই। বস্তুত, অ্যাডাম স্মিথ বলিতেন, যাঁহার সহিত ভারতের যোগ নাই, তেমন কাহারও সমালোচনাই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনি ‘নিষ্পক্ষ দর্শক’। ভারতে তাঁহার কোনও পক্ষপাত নাই। কিন্তু, অশিক্ষা আর কবে শীলিত যুক্তির ধার ধারিয়াছে! তাহার স্মার্টফোন আছে, তাহাই যথেষ্ট।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Smartphone incoherent
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE