প্রতীকী ছবি।
গোটা দেশ স্তম্ভিত। প্রকাশ্য দিবালোকে, জনসমক্ষে, এক নেশাগ্রস্ত পুরুষ এক মহিলাকে ধর্ষণ করিল, বহু লোক সেই দৃশ্য দেখিয়াও চোখ ফিরাইয়া চলিয়া গেলেন, কেউ কেউ তাহার ভিডিয়ো রেকর্ডিং-ও করিলেন, কিন্তু এক জনও মহিলাকে বাঁচাইতে অগ্রসর হইলেন না। বিশাখাপত্তনমের ঘটনা। অনেকেই সবিস্ময় ভাবিতেছেন, কী ভাবে মানুষ এতখানি মনুষ্যত্বহীন হইতে পারে! প্রশ্নটি আবেগমথিত, কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, মনুষ্যত্ব বা মানুষের স্বভাবধর্ম বস্তুটি সময় ও সমাজ-নিরপেক্ষ নহে। তাহা পারিপার্শ্বিকের প্রেক্ষিতে নির্মিত হয়। কোনও একটি জনজাতির নাকি নিয়ম ছিল, জন্মকালে দুর্বল শিশুকে পর্বতের উপর হইতে ছুড়িয়া ফেলা হইত। দুর্বল শিশুকে বাঁচিতে দিলে কালেক্রমে গোটা জাতিই শারীরিক ভাবে দুর্বল হইয়া পড়িবে— এই ‘বিপদ’ ঠেকাইতেই এহেন নিয়ম। আধুনিক সময়ের প্রেক্ষিতে এই প্রথাটিকে চূড়ান্ত বর্বর, অ-মানবিক বোধ হইতে বাধ্য। কিন্তু, প্রথাটি যে সময়ে, যে প্রেক্ষিতে যে জনজাতির ছিল, তাহার কাছে এই প্রথাটিই ‘স্বাভাবিক’ হিসাবে গণ্য হইত। গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যক্তিকে বিসর্জন দেওয়া যায় কি না, অথবা সম্পূর্ণ যূথবদ্ধ জীবনেও একটি শিশুর প্রাণের উপর সেই যূথের, এমনকী পরিবারেরও, অধিকার থাকিতে পারে কি না, এই দার্শনিক তর্কগুলিতে প্রবেশ করিবার প্রয়োজন নাই। প্রশ্নটি নৈতিকতার নহে, প্রশ্ন বিবেচনার— ‘মনুষ্যত্ব’ নামক বস্তুটি বিবেচনার উপর নির্ভরশীল। মানুষের নিকট যা অস্বাভাবিক, বা অগ্রহণযোগ্য ঠেকে, তাহার প্রতিবাদ করা, প্রতিকার করাই মনুষ্যত্ব। কোনও অস্বাভাবিকতার প্রতিকার করিবার কারণ, অধিকার এবং সাধ্য আছে জানিয়াও নিশ্চেষ্ট থাকাকে অমানবিক বলিয়া চিহ্নিত করা চলে। বিশাখাপত্তনমের দর্শকদের কি সেই দোষে দুষ্ট বলা যায়?
‘দর্শক’ শব্দটি অহেতুক নহে। বর্তমান সময় অবিরাম দৃশ্যের জন্ম দিয়া চলিতেছে। স্থির, এবং চলমান। টেলিভিশনের পরদায়, সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায়, এবং অতি অবশ্যই সর্বগ্রাসী সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই সময়ের মানুষরা মূলত দর্শক— দৃশ্যের উপভোক্তা। এবং ভোগবাদের দুনিয়ায় উপভোগের ধর্মই হইল উৎপাদনের সহিত বিচ্ছিন্নতা। মানুষ প্রতিনিয়ত যে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়া চলে, তাহার সহিত সম্পর্কটি একমুখী— মানুষ শুধু দেখে, দৃশ্যের উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ নাই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ধৃতরাষ্ট্রের যেমন শ্রোতা, অথবা এক অর্থে দর্শকের ভূমিকা ছিল— বর্তমান সময়ে দর্শকের ঘটনার সহিত ‘এজেন্সি’বিহীন বিচ্ছিন্নতা হয়তো সেই মহাকাব্যিক মাপকে ছুঁইয়াছে। এবং, এক দৃশ্য হইতে অন্য দৃশ্যে চলিয়া যাওয়া, এবং পূর্বের দৃশ্যটি অন্তত আংশিক ভাবে বিস্মৃত হওয়াই নিয়ম। বিচ্ছিন্নতাটি সর্বগ্রাসী। দর্শকের ক্রমে বিশ্বাস জন্মাইয়া যায়, তাহার কিছু করিবার নাই, কারণ দৃশ্যের জন্ম এবং বহমানতা তাহার নিয়ন্ত্রণের অতীত। ভাবিয়া দেখিলে, ধর্ষণও কি সেই নিরন্তর দৃশ্যপ্রবাহের অঙ্গ নহে? নির্ভয়া-কাণ্ডই হউক অথবা প্রতি দিন ঘটিয়া চলা অন্যান্য নির্যাতনের কাহিনি, দর্শকের নিকট দৃশ্য হিসাবেই পৌঁছাইয়াছে। সংবাদ বটে, কিন্তু দৃশ্যে অভ্যস্ত মনের কাছে তাহার অবস্থান একটি নিঃস্পৃহ দূরত্বে। বিশাখাপত্তনমে যাঁহারা ধর্ষণের ঘটনাটিকে দেখিয়া চোখ ফিরাইয়া চলিয়া গেলেন, যাঁহারা দাঁড়াইয়া দেখিলেন, যাঁহারা মোবাইল ফোনে রেকর্ড করিয়া নিলেন, তাঁহারা কি এই দৃশ্য-দর্শক বিচ্ছিন্নতারই সন্তান নহেন? দৃশ্যের উপভোক্তা হইবার সামাজিক নিয়ম সম্ভবত তাঁহাদের এজেন্সির বোধকে মারিয়া ফেলিয়াছে। কোনও দৃশ্যে যে তাঁহাদের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন থাকিতে পারে, সেই হস্তক্ষেপ যে মনুষ্যত্বের প্রাথমিক শর্ত হইতে পারে, এই বোধটি সম্ভবত তাঁহাদের আর নাই। ফলে, প্রশ্ন যদি করিতেই হয়, তবে এই উপভোগের ধর্মটিকে করা প্রয়োজন— মনুষ্যত্বের অভাব তাহার ফল, কারণ নহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy