Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

সর্বঘটে কাঁঠালি স্টার

শুধু বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নয়, আমরা অতীতও রেগুলার তৈরি করি। আমাদের উপদেশ টুকে লোকে ভগৎ সিংহকে স্যালুট জানায়। গাঁধীজিকেও তো রাজকুমার হিরানিই তুলল। আমাকে ভারতের পক্ষ থেকে অলিম্পিকের গুডউইল অ্যাম্বাসাডর করা হল, তাই নিয়ে কাঁইকাঁই চলছে? যে দেশের জন্যে লাখ লাখ স্টেপ নাচলাম, কোটি বার শার্ট ছিঁড়ে টপলেস হলাম, তেলচুকচুকে খালি গায়ে তুড়ুক লাফালাম, শয়তানদের কানচাপাটি মেরে মুঠো লাল করে ফেললাম, মাঝে মাঝে এমনকী অ্যাক্টিং-এর ভান অবধি করলাম গ্লিসারিন লুকিয়ে— সেই দেশের লোক আমাকে বলছে, ভারতের হয়ে স্টেজে উঠতে দেবে না! এত স্যাক্রিফাইসের পর এই আমার প্রাপ্য!

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৬ ০০:৫০
Share: Save:

আমাকে ভারতের পক্ষ থেকে অলিম্পিকের গুডউইল অ্যাম্বাসাডর করা হল, তাই নিয়ে কাঁইকাঁই চলছে? যে দেশের জন্যে লাখ লাখ স্টেপ নাচলাম, কোটি বার শার্ট ছিঁড়ে টপলেস হলাম, তেলচুকচুকে খালি গায়ে তুড়ুক লাফালাম, শয়তানদের কানচাপাটি মেরে মুঠো লাল করে ফেললাম, মাঝে মাঝে এমনকী অ্যাক্টিং-এর ভান অবধি করলাম গ্লিসারিন লুকিয়ে— সেই দেশের লোক আমাকে বলছে, ভারতের হয়ে স্টেজে উঠতে দেবে না! এত স্যাক্রিফাইসের পর এই আমার প্রাপ্য! ওরে, দিনরাত্তির এক করে খাটছি, যাতে তোরা একটু আনন্দ পাস, তোদের প্যান্তাখ্যাচাং জীবনে একটু মস্তি আসে। হরিণরা শার্প শিং দিয়ে পাছে গুঁতিয়ে দেয়, তাই তাদের মেরে দেশের জঙ্গল নিরাপদ রাখছি। ফুটপাতে মানুষগুলো পড়ে পড়ে ঘুমোলে দেশের ইমেজ বিদেশিদের কাছে খারাপ হয়, তাই গাড়িচাপা দিয়ে ছোটলোকগুলোকে নিরস্ত করার চেষ্টা করছি। এই সাংঘাতিক দেশসেবা তোদের মাথায় ঢুকছে না?

আমি নাকি খেলার সঙ্গে সম্পর্কিত নই, তাই আমার অলিম্পিকে দেশদূত হওয়া সাজে না! খেলা জিনিসটা কি জীবনের বাইরে? আমোদ-বন্দোবস্তের পরিধির বাইরে? ওটা কি একটা জল-অচল ক্ষেত্র, কাঁটাতার লাগানো নো-এন্ট্রি জোন? কক্ষনও না। যা কিছু আনন্দের সঙ্গে, সুখের সঙ্গে চিপকে আছে, সবেতেই আমি ঢুকে পড়তে পারি। ঠিক যে ভাবে ফুলঝুরি বা কালীপটকার প্যাকেটে সুন্দরী মেয়ের ছবি অবধারিত হয়ে পড়ে, তেমনই, যেখানেই মজা আছে, আমায় দেখলেই মজাটা ডবল হয়ে যাওয়ার ফ্যান্টাসি মনে টুকি মারে। যে বিরাট হয়, সে সর্বঘটে বিরাজ করে, এটাই নিয়ম। রবীন্দ্রনাথের গান শ্রাদ্ধেও লাগসই, মুখেভাতেও। মিষ্টান্ন ভাণ্ডারেও তাঁর ছবি, হার্টের হসপিটালেও তাঁর নাম। তা হলে আমি কী দোষ করলাম? সিনেমায়, রিয়েলিটি শো-র অ্যাংকরিং-এ, গাদা গাদা বিজ্ঞাপনে সারা ক্ষণ ঝলসাচ্ছি, আর খেলার বেলায় আমার দাপানি দেখলেই তোরা বলবি, আসলি খেলোয়াড় লাও! সচিন তেন্ডুলকর যখন রাজ্যসভায় গেল, চিক্কুর তুলে জিগেস করেছিলি কি, ও রাজনীতির কী বোঝে?

অ্যাম্বাসাডর বল আর মারুতি বল, আমি হব না তো কে হবে? এই দেশে যা কিছু ঘটে, তাতেই তো আমাকে চিফ গেস্ট করা উচিত! দুর্গাপুজো, ভিতপুজো, কবি সম্মেলন, ষাঁড়ের রেস, স্যাটেলাইট নিক্ষেপ, ভূমিকম্প। সঅব। কারণ আমিই তো ভারতের সুলতান। ভারতকে চালাচ্ছে কে? বলিউড। ভারতকে একই সূত্রে বেঁধে রেখেছে কে? বলিউড। সমগ্র দেশে কোন গান গুনগুনানো হবে, কী টপিকে আড্ডা জমবে, দোকানে কোন ফ্যাশনের জামাকাপড় উঠবে, ঠিক করে দেয় কে? বলিউড। সেই বলিউডের সবচেয়ে হিট স্টার কে? কার সিনেমা রিলিজ করলে তার কয়েকশো মাইলের মধ্যে অন্য কোনও ছবি রিলিজ করতে থরথরিয়ে কাঁপে? জেমস বন্ডের মুভি অবধি কাকে ভয় পায়? তা হলে, আমিই কি ভারতের জমিদার নই? ভারতকে ইচ্ছেমতো পায়ে নাচাব না? ড্রপ খাইয়ে, ফের খপাৎ লুফে নেব না? ভোরবেলা বাথরুম যাওয়ার আগে ভারত-ভারত খেলব না?

কী সব জঘন্য কাদা-ছোড়াছুড়ি! আমার নতুন সিনেমায় আমি কুস্তিগিরের রোল করছি, তাই নাকি অলিম্পিককে সিনেমাটার প্রোমো হিসেবে ব্যবহার করছি! ছিছি! এ সব করে আমায় ছবি প্রোমোট করতে হয়? অলিম্পিকের বছরের বদলে অন্য বছর এ সিনেমা করলে, সুপারহিট হত না? প্রতি বার ইদ-এ আমার একটা সিনেমা বেরোয়, রকেটের স্পিডে আগের সব রেকর্ড ভেঙে আকাশে উঠে স্টিল! আমি যদি ফিল্মটা করে সুড়ঙ্গে লুকিয়েও বসে থাকি, লোকে খুঁজে বের করে মালা পরিয়ে মাথায় তুলে নাচবে রে! স্পোর্টস বরং আমায় পেয়ে ধন্য হবে। যে, হুজুর, আপনি আমাদের এই আর্ট ফিলিম মার্কা গুঁজড়ে মরা ব্যাপারটাকে দৈব গ্ল্যামার চুঁইয়ে এট্টু লাইমলাইট দিলেন, এই যে লোকে এ বার ‘আরে! গুরু বলছে! তবে তো এই খেলাগুলো দেখলেও হয়!’ বলে চেগে উঠবে, এই যে অলিম্পিক জিনিসটা কী তা নিয়েও চিড়িক ইন্টারেস্ট জাগবে দিগন্তে, এ জন্য শত পেন্নাম। যারা উঁচুতে উঠে যায়, নিচুকে টেনে তোলার স্লাইট দায়িত্ব তাদের থাকে। আমি যেমন কয়েকটা এনজিও করেছি, সে ভাবেই খেলাগুলোকেও একটু হেঁইয়ো পুশ দিতে এলাম, স্পোর্টসম্যানগুলো যদি আমার বেয়ারার মতোও ইনকাম করে উঠতে পারে! ওরাও তো মানুষ, ওরাও তো খাটছে। কে নাগাড়ে ডিগবাজি খাচ্ছে, কে ছাতার বাঁটের মতো লাঠি দিয়ে বল পেটাচ্ছে, আহা রে! শুনেছি সারা দিন রোদ্দুরে প্র্যাকটিস করে!

অকৃতজ্ঞ মিলখা সিংহ আবার আমাকে টোন কাটছে! কে মিলখা! ফারহান ওর অভিনয় না করলে কে ওকে চিনত! তুমি কবে কোন প্রকাণ্ড কাণ্ড করেছিলে, কোন কুইজের বইয়ে তোমার নামে চাড্ডি কোশ্চেন মিটমিট, তাতে কিস্যু এসে যায় না। বলিউড যদি তোলে, তবে হিস্ট্রিতে ঢুকলে। নইলে, বাইরে দাঁড়িয়ে ঘ্যানঘ্যানাও। আমরা যদি জগদীশ বোসকে নিয়ে মুভি করি, কাল থেকে উনি মেগাফেমাস। লোকে আর গাছ ছিঁড়বে না। অবশ্য অবলা বসুর সঙ্গে নাচাগানার ছ’টা সিন রাখতে হবে। যদি ইরম শর্মিলা চানুকে নিয়ে ছবি করি, লোকে রেস্তরাঁয় গিয়ে বলবে, নাকে নল দিয়ে খাব। আমরা যেটা করব, সেটাই মার্কেটে এন্ট্রি নেবে, সেটাই ভারতের জীবনে ডাইরেক্ট চালু। তাই, শুধু বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নয়, আমরা অতীতও রেগুলার তৈরি করি। আমাদের উপদেশ টুকে লোকে ভগৎ সিংহকে স্যালুট জানায়, জোধা আর আকবরকে গুগ্‌ল করে। গাঁধীজিকেও তো রাজকুমার হিরানিই তুলল। তাই সাবধানে থেকো ভাই, যদি কাল ভিলেনের নাম মিলখা করে দিই, মুদির দোকানেও যেতে পারবে না। পচা ডিমের তোড়ে চারশো মিটার পাঁইপাঁই ছুট্টে বাড়ি ফিরতে হবে!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE