Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘শিখছে না, শিখবেও না’

পাশ-ফেল ফিরে এলে কী লাভ হবে? প্রত্যন্ত গ্রামের এক প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক তা নিয়ে কথা বললেন। পুরুলিয়ার ঝালদা ২ ব্লকটি সাক্ষরতার নিরিখে রাজ্যের প্রায় শেষ প্রান্তে, দারিদ্র তীব্র।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

রোগ সারানোর ক্ষমতা ডাক্তারের ক্ষমতার উৎস নয়। মেডিক্যাল সার্টিফিকেট লেখার অধিকারই তাঁর ক্ষমতার উৎস। কে রোগী, আর কে সুস্থ, তা কেবল ডাক্তারই বলতে পারেন, তাই তাঁর এত প্রতিপত্তি। কথাটা বলেছিলেন ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো। আন্দাজ হয়, শিক্ষকদের ক্ষমতার উৎসও তেমনই। ছাত্রদের ভাষা, ইতিহাস, অঙ্ক পড়ানোর ক্ষমতা আছে বটে শিক্ষকের। কিন্তু কে পাশ আর কে ফেল, তার সার্টিফিকেট দিতে পারেন একমাত্র শিক্ষক, সেই জন্যই তিনি ক্ষমতাবান। পাশ-ফেল তুলে দিয়ে সে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল শিক্ষার অধিকার আইন। আট বছরের মাথায় রাজ্যের শিক্ষকরা সে ক্ষমতা ফিরে পাচ্ছেন। আজ, শনিবার, বিকাশ ভবনে পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনা নিয়ে আলোচনার সূচনা হচ্ছে।

পাশ-ফেল ফিরে এলে কী লাভ হবে? প্রত্যন্ত গ্রামের এক প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক তা নিয়ে কথা বললেন। পুরুলিয়ার ঝালদা ২ ব্লকটি সাক্ষরতার নিরিখে রাজ্যের প্রায় শেষ প্রান্তে, দারিদ্র তীব্র। স্কুলের অধিকাংশ পড়ুয়া জাতে কুমার। মায়েদের প্রায় কারও অক্ষরজ্ঞান নেই, নিজের বয়সও বলতে পারেন না, বিড়ি বেঁধে সংসার চালান। অনেকেই চার-পাঁচটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, একাধিক শিশুসন্তানের মৃত্যু দেখেছেন। এলাকায় খেতমজুরির রেট দিনে দেড়শো টাকা, প্রাইভেট টিউশনের রেট মাসে একশো টাকা।

গ্রামের নামে নামাঙ্কিত প্রাথমিক স্কুলটির পড়ুয়া ২২৮, শিক্ষকের সংখ্যা আট। একটি জাতীয় স্তরের অসরকারি সংস্থা স্কুলটিতে কাজ করছে। তাদের সমীক্ষা অনুসারে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে একষট্টি জন পড়ুয়ার মধ্যে তেরো জনের অক্ষর পরিচয় হয়নি, ছাব্বিশজন শুধু অক্ষর চিনতে পারে। ভাষা ও অঙ্কে সকলেই শ্রেণির চাইতে পিছিয়ে।

প্রশ্ন: আপনার স্কুলে তিন-চার বছর পড়াশোনা করেও অধিকাংশ পড়ুয়া বাংলা বাক্য পড়তে, সংখ্যা চিনতে পারছে না। কেন?

উত্তর: এই গ্রামের বাবা-মায়েরা স্কুলের সঙ্গে টাচ রাখেন না। ছেলেমেয়ে কোন ক্লাসে পড়ছে, জানেন না। সকালে-বিকেলে দু’ঘণ্টা যে পড়তে বসাবেন, তা-ও করেন না। তাই ক্লাসে টিচার যখন স্পিচ দিচ্ছেন, বাচ্চারা শুনছে কিন্তু ডাইজেস্ট করতে পারছে না।

প্র: আপনি তো পাশের গ্রামেই থাকেন? এই গ্রামের লোকেরা যে অক্ষর চেনেন না, বাড়িতে পড়াতে পারবেন না, তা তো জানেন?

উ: জানি।

প্র: স্কুলের মূল্যায়নে ছাত্ররা কেমন করেছে?

উ: সেখানেও তাদের ফল ভাল নয়।

প্র: অসরকারি সংস্থার কর্মীদের দাবি, এক মাস ক্লাস নেওয়ার পর অধিকাংশ ছেলেমেয়ে পড়তে শিখেছে, অনেক বেশি ছেলেমেয়ে স্কুলে ক্লাস করতে আসছে। এটা কি ঠিক?

উ: হ্যাঁ, ওঁরা হার্ড লেবার দিচ্ছেন। উন্নতি হচ্ছে।

প্র: তা হলে ক্লাসে শিখছে না কেন? আপনাদের তো আট জন শিক্ষক, আদর্শ অনুপাত থেকে বেশি।

উ: আমাদের মাত্র তিনটে ক্লাস রুম। অঙ্গনওয়াড়ি, প্রি-প্রাইমারি ক্লাসের পড়ুয়ারা এসে যায়, বিরক্ত করে। আমরা বাড়তি ক্লাসরুমের টাকা পাইনি।

প্র: তবু, এঁরা দু’জন যখন শেখাতে পারছেন, আপনারা আট জন ...

উ: এঁরা খেলার মাধ্যমে পড়াচ্ছেন। আমরা চতুর্থ শ্রেণির গোটা ক্লাসকে ও ভাবে পড়াতে পারি না, তাতে সিলেবাস শেষ হবে না।

প্র: শিক্ষক সিলেবাস শেষ করলেও, অধিকাংশ ছেলেমেয়ে যদি প়ড়া বুঝতেই না পারে, তাতে কী লাভ?

উ: সেটাই তো সমস্যা।

প্র: সমাধান কী?

উ: এখন বয়সের সঙ্গে ক্লাস বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নয় বছর বয়সে ক্লাস ফোরেই থাকতে হবে। এই জন্য বাচ্চারা শিখছে না।

প্র: মানে পাশ-ফেল ফেরাতে হবে।

উ: হ্যাঁ, (একটু থেমে) কিন্তু তাতেও লাভ হবে না। বছর বছর ফেল করতেই থাকবে।

প্র: ফেল করলে গোটা একটা বছর নষ্ট হবে। অথচ দেখা যাচ্ছে যে এক-দেড় মাস ঘণ্টাখানেক করে পড়ালে শিশুরা শ্রেণি উপযোগী পড়া শিখে যাচ্ছে। ক্লাসে ‌এ ভাবে পড়ানো হয় না কেন?

উ: খেলার মাধ্যমে, ছোট ছোট দলে ভাগ করে পড়ানোর পদ্ধতি টিচার্স ট্রেনিংয়েও শেখানো হয়। কিন্তু শিক্ষকেরা প্রধানত লেকচার মেথডটাই পছন্দ করেন। তা ছাড়া ব্ল্যাক বোর্ড ব্যবহার করা, ডায়ালগ মেথড, এগুলো তো ফলো করাই হয়। আমাদের শিক্ষকেরা ভাল।

প্র: কী অর্থে ‘ভাল’ বলছেন?

উ: ভাল না হলে সরকার তাদের চাকরি দিল কী করে? পরীক্ষা দিয়ে, মার্কশিট দেখিয়েই তো চাকরি পেয়েছে।

প্র: কিন্তু ক্লাসে ছেলেমেয়েরা যে শিখছে না?

উ: চাকরি পেলে নৈতিকতা হারিয়ে যায়। যখন লোকে বেকার থাকে, তখন চাকরি পাওয়ার জন্য সব কিছু করতে রাজি থাকে। কিন্তু তার পর ‘কেন পড়াচ্ছি,’ সেটা মনে করতে পারে না।

প্র: আপনাদের স্কুল এত অপরিষ্কার কেন? দোরগোড়ায় খোলা নর্দমা, চার দিকে পাঁক, আবর্জনা জমে আছে...

উ: কেউ পরিষ্কার করে না। নোংরা জমে খোলা ড্রেনে জল আটকে যায়। মাঝেমাঝে বাচ্চাদেরই বলি, দু’হাতে করে ময়লা তুলে পুকুরে ফেলেদিয়ে আয়।

প্র: বাচ্চারা হাতে করে নর্দমা থেকে পাঁক তোলে?

উ: আর কে তুলবে? তার পর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে বলি।

সংযোজন: স্কুলের আশেপাশে বাড়ি যে পড়ুয়াদের, তাদের অভিভাবকেরা এক বাক্যে বললেন, প্রাথমিক স্কুলে খুব ভাল পড়াশোনা হয়। মাস্টারমশাইরা নিয়মিত আসেন, যত্ন করে পড়ান। ছেলেমেয়েরা শিখছে না, সে তাঁদের দোষ নয়। মা সরস্বতী যেমন মাথা দেবেন, তেমনই তো শিখবে। মা-বাবা ‘প্রাইভেট’-এ দিতে পারেন না। তাই ছেলেমেয়ে শিখছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Students School Pass-Fail
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE