Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

কেউ হাত ধুয়ে ফেলতে পারি না

এই পরিস্থিতির পিছনে সলতে পাকানোর দীর্ঘ ইতিহাসটা ভুলে গেলে মস্ত ভুল হবে। ছাত্রদেরও ভাববার সময় হয়েছে যে, তাঁরা আর কত দিন রাজনীতির দাবার বোর্ডে বোড়ের ভূমিকা পালন করবেন।এই পরিস্থিতির পিছনে সলতে পাকানোর দীর্ঘ ইতিহাসটা ভুলে গেলে মস্ত ভুল হবে। ছাত্রদেরও ভাববার সময় হয়েছে যে, তাঁরা আর কত দিন রাজনীতির দাবার বোর্ডে বোড়ের ভূমিকা পালন করবেন।

সম্মান? ‘ছাত্র’রা ও উপাচার্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

সম্মান? ‘ছাত্র’রা ও উপাচার্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

বোলান গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৫ ০০:৫৪
Share: Save:

এক দল উত্তেজিত ছাত্র তালি বাজাচ্ছে, নানা অঙ্গভঙ্গি করছে আর মুখে স্লোগান চলছে। তার মধ্যে স্থির, নিশ্চুপ শিক্ষককুল অপলক চেয়ে আছেন। চাউনিতে কোনও ভাষা নেই। যেন নিজেদের মৃতদেহ দেখছেন। এরই মধ্যে ক্যামেরার ফোকাস গিয়ে পড়ে এক জন মানুষের মুখে। চশমা-চোখে, বিরলকেশ সর্বকায় এক ব্যক্তি। ভি়ড়ের মধ্যে কিছু বলতে বা করতে চেষ্টা করছেন। ক্যামেরার এ পাশে আমরা যারা দর্শক, শনাক্ত করতে চাই, ‘আরে, ইনিই তো উপাচার্য, তাই না?’ শনাক্তকরণের মধ্যেই দেখি, উত্তেজিত ছাত্ররা তাঁকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। মনে হল, এক ঝলক দেখলাম তাঁর কলারে কেউ হাত দিয়েছে...

বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের এই ছবি গত ১ জুলাই সারা দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের তো বটেই, গোটা ভারতের সমাজকেও নাড়া দিয়ে গেছে। যাঁরা একটু দোলাচলে ছিলেন, তাঁরাও সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন, ‘আর যা-ই হোক, এ রাজ্যে লেখাপড়াটা হবে না। ছেলেমেয়েরা একটু বড় হলেই, স্কুলটা শেষ করেই, বাইরে পাঠিয়ে দিতে হবে। বিলেত আমেরিকা না হোক, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, আমদাবাদ, যেখানে হোক, পাঠিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত।’ খরচ একটু বাড়বে। ভাতের পাতে হয়তো সাত দিনের বদলে মাছের টুকরো তিন দিনে ঠেকবে। তা ঠেকুক। তবু এই পরিবেশ থেকে বের করে দিতে হবে। আর যাঁরা জানেন যে, এক বেলা উপোস দিলেও ছেলেমেয়েদের বাইরে পাঠানোর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে, তাঁরাও মনে মনে লেখাপড়া শিখে ছেলেমেয়ের উঠে দাঁড়ানোর স্বপ্নটাকে একটু কাটছাঁট করে নেন।

এই অসহায় অবস্থার মধ্যে সঙ্গত ভাবেই পাড়ার রক থেকে কফি হাউস, এমনকী অভিজাত ড্রয়িং রুম পর্যন্ত আলোচনায় উঠে আসে নির্দিষ্ট দলের ছাত্রদের (যাদের ক্যামেরায় চেনা গেছে) প্রতি ধিক্কার। প্রশাসন, শাসক দল আর উপাচার্যের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা। সমালোচনা অহেতুক নয়। সত্যিই তো, এই জমাট অন্ধকার থেকে বেঁচে বেরোবার রাস্তাটা কেউই দেখতে পাচ্ছেন না, যাঁদের দেখানোর কথা তাঁরাও যেন সারাক্ষণ নানান গূঢ় হিসেবনিকেশের তাড়নায় বিব্রত, কী করা উচিত সে কথা জেনেও তাঁরা যেন তা করে উঠতে পারছেন না।

কিন্তু তার পরেও একটা কথা থেকে যায়। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির পিছনে দীর্ঘ একটি সলতে পাকানোর ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসটা ভুলে গেলে মস্ত ভুল হবে। ক্ষয়ক্ষতির বোঝাও বাড়বে। শুধু সাম্প্রতিকের কথা ভাবলে এবং সেখানেই ভাবনাটা থামিয়ে দিলে সমস্যার কেশাগ্রও স্পর্শ করা যাবে না।

১৯৭১ সালে স্কুল শেষ করে যখন স্কটিশ চার্চ কলেজের সিঁড়িতে পা রেখেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গে তখন রক্তস্নানের উৎসব চলছে। সে উৎসবে সবাই শামিল। যাঁরা ‘শ্রেণিশত্রু খতম করো’ আহ্বান জানিয়েছিলেন, যাঁরা মহাত্মা গাঁধীর অহিংস নীতির ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিলেন, অথবা গাছেরও খাব আর তলারও কুড়োব নীতি, মানে ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলব, আবার সংসদীয় গণতন্ত্রের যাবতীয় সুবিধা ভোগ করব’ নীতি যাঁদের— সকলেই নেমে পড়েছিলেন যে যার অস্ত্র নিয়ে এই উৎসবে শামিল হতে। সেই প্রথম বোধহয় গণতান্ত্রিক যুক্তি বুদ্ধি
আর ন্যায়নীতির ধারণা বদলাতে শুরু হল। যে যুক্তিবোধ তেতাল্লিশের মন্বন্তর বদলাতে পারেনি, সাতচল্লিশে দেশভাগের চাপেও যা ভেঙে পড়েনি, সত্তরের রাজনৈতিক হঠকারিতা সেখানেই ঘা দিল। বহিরঙ্গের রক্তপাত অন্তরঙ্গে প্রবেশ করল। শুরু হল আদর্শ জলাঞ্জলির রাজনীতি। কার স্বার্থে কে খুন হয়ে যাচ্ছে, সে হিসেবও গুলিয়ে গেল।

একাত্তরে প্রথম কলেজে ঢুকে দেখলাম ছাত্র পরিষদের দাপট। ভর্তির লাইনে রসিদ কেটে টাকা তোলা। আবেদন জানানো নয়, নির্বাক থেকে পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করা। শুধু স্কটিশ চার্চ নয়, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত কলেজে তখন ছাত্র পরিষদ ছাড়া কিছুই নেই। সাড়ে বারোটার সময় আমাদের দশ-পনেরো মিনিটের একটা টিফিন হত। সেই সময় ঘুরে ঘুরে ইউনিয়নের ছেলেরা স্লোগান দিত: ‘লাল গোলামি ছেড়ে বল বন্দে মাতরম্’। প্রথমে শুধু ওই দশ-পনেরো মিনিট। পরে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের দাপট যত বাড়তে লাগল, স্লোগানের সময়টাও বাড়তে লাগল। ক্লাস চলাকালীন ওই উচ্চকিত স্লোগান। মাস্টারমশাইরা দরজা বন্ধ করে ক্লাস নিতেন। কী ভাবে যে তারা ওই অধিকার অর্জন করেছিল, জানি না। এদের অধিকাংশই বছর বছর কলেজে থেকে যেত— হয় ফেল করত, নয়তো পরীক্ষা দিত না। তাতে অবশ্য কিছু আটকায়নি। এদের অনেকেই রাজনৈতিক সক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতার অলিন্দে রাজ করেছে। এমনকী দিল্লিতেও। হঠাৎ এক দিন কলেজে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম, ঢোল বাজিয়ে নাচ হচ্ছে, সেই সঙ্গে আবির। কী ব্যাপার? ছাত্র পরিষদ জিতে গেছে। সে কী! ভোট হল কবে? হয়নি। নমিনেশনই জমা পড়েনি। দরকার কী?

ক্রমে ‘শ্রেণিশত্রু খতম’-এর রাজনীতির আহ্বান আর তেমন জোরদার রইল না। এশিয়ার মুক্তিসূর্য-র স্লোগানও কেমন যেন স্তিমিত। কিন্তু ভোট না নিয়ে ইউনিয়ন তৈরির প্রক্রিয়াটি থেকেই গেল।

এক প্রজন্ম পরে ১৯৯৬ সালে যখন আমার ছেলে প্রেসিডেন্সির সিঁড়িতে পা রাখল, তখন ইউনিয়নের দখল নিয়েছে এসএফআই। দখল নয়, আসলে জবরদখল। অন্য কারও নমিনেশন জমা দেওয়ারও অধিকার নেই। তারাই ভোটে দাঁড়ায়। জেতে। ইউনিয়ন তৈরি করে। কেউ কোনও বিমত পোষণ করতেও পারবে না। শাসক দলের হুকুম নেই। কারণ, তাদের চেয়ে আর কেউ ভাল করে জানত না যে, যদি ভোট হয় ঠিকঠাক, আর ছাত্ররা স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশ করতে পারে, তা হলে অর্ধেকেরও বেশি কলেজে তারা ক্ষমতা হারাবে। ওই সময়ই প্রেসিডেন্সির ইনডিপেনডেন্ট কনসোলিডেশন-এর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদককে সন্ধেবেলা হিন্দু হোস্টেলের সামনের রাস্তায় একা পেয়ে চেন দিয়ে মেরে আধমরা করে ফেলে রেখে যায় প্রতিপক্ষ দলের ছাত্ররা। তার অপরাধ, সে আইসি-র সমর্থক। হাট্টাকাট্টা নওজোয়ান ছেলেটা কেবল অদম্য প্রাণশক্তির জোরে হাসপাতাল থেকে বেঁচে ফিরেছিল। কেবল যে শারীরিক আক্রমণ ছিল, তা তো নয়।

জেতার নানা পন্থা ছিল। পার্টি অফিস থেকে ছাত্র ইউনিয়নের ভোটের আগে কলেজে কলেজে অবাধ মদ্যপানের টাকা আসত। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি, নম্বরও বদলে যেত বিপক্ষের ছাত্রদের। বিপজ্জনক এ খেলায়, একদল ছাত্রের সঙ্গে ছিলেন একদল অধ্যাপক। কী করে ভুলে যাব, হাতেকলমে নম্বর বদলানোর কাজটা করতেন তাঁরাই। শিক্ষককে সম্মান করা ছাত্রের দায়িত্ব বলে আজ যাঁরা ফরমান জারি করছেন, তাঁরা এই সব ভুলে গেছেন বলেই মনে হয়। ২০০০ সালের পর, প্রেসিডেন্সিতে এক জন শিক্ষক ছিলেন, যিনি একই সঙ্গে তিনটি সরকারি কাজে বহাল ছিলেন। এই রকম এত ঘটনা আছে যে শেষ করা যাবে না।

আজ নতুন নয়, বহু দিন ধরেই ছাত্র রাজনীতির নিজস্ব কোনও কর্মসূচি নেই, বক্তব্যও নেই। ছাত্র সংগঠন ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতা-প্রত্যাশী রাজনৈতিক দলের শাখা-সংগঠন হয়ে পড়েছে। ফলে তারা যেমন নাচায়, এরা তেমনই নাচে। দলীয় পতাকা বইবার জন্য কাঁধ আর মস্তিষ্ক ভাড়া দিতে দিতে আমাদের ছাত্রসমাজ ভুলেই যাচ্ছে তাদের স্বতন্ত্র পরিচয়। আর সেই জন্যই সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা এবং সহমর্মিতা থেকেও তারা বঞ্চিত। ব্যতিক্রম যে নেই, এটা বলা যাবে না। যেমন, ইদানীং কালে যাদবপুরের ‘হোক কলরব’ আন্দোলন। কিন্তু তা ব্যতিক্রমই।

শাসক দলের আত্মঘাতী রাজনীতিতে ছাত্রদের ব্যবহারের এই প্রক্রিয়া কিন্তু কোনও কালেই সামাজিক স্বীকৃতি পায়নি। গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত পরমতসহিষ্ণুতা। তাকে ভুলিয়ে দেওয়ার এই প্রচেষ্টা তাই চিরকালই সমাজবিচ্ছিন্ন এক প্রক্রিয়া। এবং এটাই এই প্রক্রিয়ার মূল ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার দায় সব পক্ষেরই, কেউ হাত ধুয়ে ফেলতে পারেন না। আর, এই একুশ শতকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে ছাত্রদেরও ভাববার সময় হয়েছে যে, তাঁরা আর কত দিন, কত ভাবে রাজনীতির দাবার বোর্ডে বোড়ের ভূমিকা পালন করবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE