কংগ্রেসের এক সমাবেশে ‘জনগণমনঅধিনায়ক জয় হে’ গীত হইতেছিল, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী উঠিয়া দাঁড়ান নাই। সংগীত শেষ হইলে এক সহকর্মী তাঁহাকে প্রশ্ন করেন, ইহাতে কি জাতীয় সংগীতের অবমাননা হইল না? জাতি যাঁহাকে নিজের ‘জনক’ বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছে, সেই মহাত্মা উত্তরে বলিয়াছিলেন, সম্মান প্রদর্শনের জন্য উঠিয়া দাঁড়ানো ভারতীয় সংস্কৃতি নহে, পাশ্চাত্যের অনুকরণ মাত্র। উপবিষ্ট অবস্থাতেও বহুতর ভাবে সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব। প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি দৃশ্যত গাঁধীর এই অবস্থানের সহিত সহমত পোষণ করে না। সর্বোচ্চ আদালত জানাইয়াছে, সিনেমা হলে জাতীয় সংগীত বাজানো বাধ্যতামূলক নহে, কিন্তু কোনও প্রেক্ষাগৃহে যদি জাতীয় সংগীত বাজে, তবে তাহার সম্মানে দাঁড়ানো বাধ্যতামূলক।
আদালতের এই নির্দেশটিকে দুই ভাগে দেখাই বিধেয়। ২০১৬ সালে বিচারপতি মিশ্রের অন্তর্বর্তিকালীন নির্দেশে আদালত বলিয়াছিল, প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহে প্রতিটি প্রদর্শনীর পূর্বে জাতীয় সংগীত বাজাইতে হইবে, এবং উপস্থিত দর্শকদের উঠিয়া দাঁড়াইতে হইবে— তাহাতে প্রত্যেকের মনে দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবোধ জাগিয়া উঠিবে। বর্তমান রায়টি এক অর্থে সেই রায়টিকে খণ্ডন করিল। জাতীয় সংগীত বাজানো হইবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত সিনেমা হলের উপর ছাড়া হইয়াছে। এক বৎসরের কিছু অধিক সময়ের ব্যবধানে আদালত যে তাহার পূর্ববর্তী অবস্থানটিকে শুধরাইয়া লইয়াছে, তাহা ভারতীয় বিচারব্যবস্থার জঙ্গমতার পরিচায়ক। কিন্তু, মহামান্য আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও বলা প্রয়োজন, উদারবাদী বিবেচনাবোধটি অর্ধ পথের অধিক অতিক্রম করিতে পারিল না। জাতীয় সংগীতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিতে হইলে দাঁড়ানো ভিন্ন উপায়ান্তর নাই, এমন একটি অবস্থান ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র বা ব্যক্তির সিদ্ধান্তগ্রহণের সর্বভৌমত্বের স্বীকৃতিবাচক নহে। দাঁড়াইয়া সম্মান প্রদর্শনের রীতিটি নিঃসন্দেহে বহুজাতিক, এবং সৌজন্যসম্মত। কিন্তু তাহাকেই একমাত্র বলিয়া দাবি করিলে অন্যতর রীতিগুলি হইতে গণপরিসরের অধিকার কাড়িয়া লওয়া হয়। দাঁড়াইতেই হইবে, এমন মৌলবাদী দাবি নাগপুরের বাহুবলীদের হইতে পারে— তাহারা ভারতীয় সংস্কৃতির স্বঘোষিত ধ্বজাধারী হইলেও সেই সংস্কৃতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। কিন্তু, দেশের সর্বোচ্চ আদালত এমন একটি অবস্থান লইলে তাহা দুর্ভাগ্যের।
জাতীয় সংগীত চলাকালীন উঠিয়া দাঁড়াইতেই হইবে, এমন কোনও নির্দেশ ১৯৭১ সালের ‘দ্য প্রিভেনশন অব ইনসাল্টস টু ন্যাশনাল অনর’ আইনে নাই, ইহা তুলনায় গৌণ বিবেচনা। বৃহত্তর প্রশ্ন হইল, আদৌ কেন এমন একটি বিষয় লইয়া এই বিপুল সময়, অর্থ এবং মনঃসংযোগ ব্যয় করিতে হইবে? সিনেমা হল যে আদৌ জাতীয় সংগীত বাজাইবার জায়গা হইতে পারে না, এই কথাটি বুঝিয়া লওয়া কি এমনই দুষ্কর? কেন্দ্রীয় সরকার আন্তঃমন্ত্রক গোষ্ঠী তৈরি করিয়া বিচার করিতেছে, কোন কোনও অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাহিতে হইবে, এবং সেই মুহূর্তে সম্মান প্রদর্শনের আদর্শ পন্থাই বা কী। মোদী সরকারের মন্ত্রীদের কি কাজ কম পড়িয়াছে? একটি উদারবাদী দেশের সরকার যদি নাগরিকদের ‘অছি’ না হইয়া ‘অভিভাবক’ হইয়া উঠিতে চাহে, কে কোথায় কতখানি যাইবেন তাহা বলিয়া দিতে চাহে, তবে সেই প্রবণতাকে প্রতিরোধ করাই বিধেয়। দেশের সাংস্কৃতিক বহুত্বকে অস্বীকার করিয়া এক অভিন্ন চলন গোটা দেশের উপর চাপাইয়া দেওয়ার গৈরিক প্রবণতাকে সুপ্রিম কোর্ট বারে বারেই প্রশ্ন করিয়াছে, ঠেকাইয়াছে। সেখানেই নাগরিকদের ভরসা। আদালতের বর্তমান রায়টি সেই কারণেই উদ্বেগের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy