মেঘের গর্জন অতি প্রবল হইলে ভয় হয়, বর্ষণ হইবে তো? ‘স্বচ্ছ ভারত’ লইয়া প্রচারের ধুম দেখিয়া তেমনই আশঙ্কা হইয়াছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হইতে বলিউডের একাধিক তারকা উন্মুক্ত স্থানে শৌচ বর্জনের বার্তা দিয়াছেন। প্রকল্পের তিন বৎসর কাটিয়াছে, নগর-গ্রামের জনস্থান বিষ্ঠামুক্ত করিবার জন্য সময় হাতে আর দুই বৎসর। দেশের ৬৪০টি জেলার চারশোটিই এখনও লক্ষ্য হইতে বহু দূরে। বিহারে মাত্র সাত শতাংশ গ্রাম লক্ষ্যে পৌঁছাইয়াছে, জম্মু ও কাশ্মীরে পাঁচ শতাংশ। এই হিসাবও সরকারি। অসরকারি নানা সংস্থার কর্মী-গবেষকদের দাবি, সরকারি সমীক্ষায় জল মিশিয়াছে। নির্মিত শৌচাগারটি ব্যবহৃত হইতেছে কি না, কেবল এই প্রশ্ন করিয়া থামিয়াছে সরকারি সমীক্ষা। পরিবারের সকল সদস্য কেবল শৌচাগারই ব্যবহার করিতেছেন কি না, উন্মুক্ত স্থানে শৌচের অভ্যাস ত্যাগ করিয়াছেন কি না, সে প্রশ্ন করে নাই। তৎসহ, ভগ্নপ্রায়, ব্যবহারের অযোগ্য শৌচালয়গুলিকেও ‘নির্মাণ সম্পূর্ণ’ বলিয়া গণনা করা হইতেছে। বাস্তব চিত্রটি কী, ক্রমশ প্রকাশ্য। কিন্তু ইঙ্গিত মিলিতেছে যে অপরাপর সরকারি প্রকল্পের সহিত ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্পের কোনও পার্থক্য রহিল না। কাজ সম্পন্ন করিবার চাহিতে কাজ দেখাইবার সরকারি চেষ্টাই প্রবল হইয়াছে, এবং কল্পিত সাফল্যের জয়ঢাক বাজাইয়া বাহাদুরি কুড়াইবার আয়োজন চলিতেছে। ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প গঙ্গার দূষণ কতটা কমাইল, ‘স্বচ্ছ ভারত’ রাস্তাঘাট কতটা বিষ্ঠামুক্ত করিতে পারিল, তাহা সেরেফ রাজনৈতিক চাপান-উতোরের বিষয় হইয়াই রহিয়া গেল।
অথচ ‘স্বচ্ছ ভারত’ ব্যতিক্রমী হইবার সুযোগ ছিল। প্রকল্পটি প্রচলিত রীতি অনুসারে প্রতি রাজ্যের জন্য নির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দ করে নাই। রাজ্যগুলির চাহিদা অনুসারে অর্থ দিয়াছে। এই নমনীয়তা প্রশংসনীয়। কিন্তু অধিকাংশ রাজ্যই তাহাকে গুরুত্ব দেয় নাই। সরকারি নির্মাণের সুযোগে দুই পয়সা লাভ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন কর্তারা। উত্তরপ্রদেশ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করিয়াছে, কিন্তু মাত্র পনেরো শতাংশ গ্রাম উন্মুক্ত শৌচমুক্ত হইয়াছে। এমনই হতাশ করিয়াছে গোয়া, অসম, তেলঙ্গানা এবং জম্মু ও কাশ্মীর। উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছত্তীসগঢ়, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, মেঘালয় ও সিকিম। এই রাজ্যগুলিতে তিন-চতুর্থাংশ গ্রাম সফল। লক্ষ্যে পৌঁছাইয়া গিয়াছে কেরল, গুজরাত, হরিয়ানা, হিমাচল ও উত্তরাখণ্ড। প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা খরচ করিয়া পশ্চিমবঙ্গ সাতষট্টি শতাংশ গ্রাম উন্মুক্ত শৌচমুক্ত করিয়াছে। ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্পে তিন বৎসরে ষাট হাজার কোটি টাকা খরচ হইয়াছে। লাভ যথেষ্ট হইল কি না, বিশেষজ্ঞেরা হিসাব করিবেন।
কিন্তু ‘স্বচ্ছ ভারত’ কি জনস্থানের বিষ্ঠামুক্তিতেই সীমাবদ্ধ? যথাযথ নিকাশি, আবর্জনা ফেলিবার ব্যবস্থা, বায়ু ও জলের দূষণে নিয়ন্ত্রণ, এগুলিও কি স্বচ্ছতার অধীনে নহে? এই সমস্যাগুলি দূর করিবার কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা চোখে পড়ে নাই। পঞ্চায়েত ও পুরসভাগুলি গ্রাম-নগরের আবর্জনা জাতীয় সড়কের ধারে স্তূপ করিতেছে। দিল্লির আকাশ-বাতাস প্রতি শীতে নিঃশ্বাসের অযোগ্য হইয়া উঠিতেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ক্ষেত্রে শিল্পের বর্জ্য গঙ্গাকে আজও দূষিত করিতেছে। বৃহৎ নগরগুলিতে উন্মুক্ত নর্দমা, পর্বতপ্রমাণ জঞ্জালে কীটপতঙ্গ জন্মাইয়া মহামারি ঘটাইতেছে। স্বচ্ছতাকে শৌচাগার-সর্বস্ব করিয়া দেখিবার সরকারি প্রবণতা ত্যাগ করা প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য এবং নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের নিরিখে তাহাকে বিবেচনার প্রয়োজন। স্বচ্ছতা যে জনস্বাস্থ্যে উন্নতির একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শর্ত, তাহা এই দেশের জনচেতনায় এখনও যথেষ্ট প্রোথিত নহে, সরকারি চেতনাতেও তাহার প্রতিষ্ঠা দুর্বল। এই দুর্বলতা ঘুচানো জরুরি। নচেৎ স্বচ্ছতার সন্ধান আরও একটি সরকারি প্রকল্প হইয়া রহিয়া যাইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy