Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ

জীবনব্যাপ্ত শিল্পের হদিশ তিনিই দেন

প্রথমবার বিদেশ থেকে আসার পর বাল্যবন্ধু ও চিত্রকর প্রিয়নাথ সিংহ কথা প্রসঙ্গে স্বামীজিকে বলেন, ‘সাহেবদেরও তো আর্ট বেশ।’ স্বামীজির উত্তর, ‘দূর মূর্খ! আর তোরেই বা গাল দিই কেন? দেশের দশাই এমনি হয়েছে।

আজ স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৫তম জন্মতিথি

আজ স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৫তম জন্মতিথি

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

প্রথমবার বিদেশ থেকে আসার পর বাল্যবন্ধু ও চিত্রকর প্রিয়নাথ সিংহ কথা প্রসঙ্গে স্বামীজিকে বলেন, ‘সাহেবদেরও তো আর্ট বেশ।’ স্বামীজির উত্তর, ‘দূর মূর্খ! আর তোরেই বা গাল দিই কেন? দেশের দশাই এমনি হয়েছে। দেশসুদ্ধ লোক নিজের সোনা রাঙ আর পরের রাঙটা সোনা দেখছে। এটা হচ্ছে আজকালকার শিক্ষার ভেলকি।’ স্বামীজির সাফ কথা, ‘বিলেত যাওয়ার চেয়ে জাপান যাওয়া আমাদের দেশের লোকেদের বেশি জরুরি।’ তা হলে ‘চোখ ফোটে’, কারণ ‘তারা সাহেবদের সব নিয়েছে, কিন্তু তারা জাপানিই আছে, সাহেব হয়নি।’

স্বামীজি অনুভব করেছিলেন, এশিয়াবাসীর জীবনযাপনের তুচ্ছ বস্তুতেও শিল্পের ছোঁয়া। দৈনন্দিন প্রয়োজন আর শিল্প এখানে অঙ্গাঙ্গি, তা কেবল শৌখিনতার দেয়ালে আটকে নেই। এই চর্চারই পূর্ণ প্রকাশ পেয়েছিলেন জাপানে। তাই জানাচ্ছেন, ‘ঐ আর্টের জন্যই ওরা এত বড়। তারা যে এশিয়াটিক (Asiatic)। আমাদের দেখছিস না সব গেছে, তবু যা আছে তা অদ্ভুত।’

শিল্পীবন্ধু প্রিয়নাথের সঙ্গে কথায় স্থাপত্য প্রসঙ্গও এসেছিল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের স্থাপত্যরীতির উদ্দেশ্যমূলক পার্থক্য স্বামীজি বিশ্লেষণ করেছেন। কলকাতা তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী, ব্রিটিশ স্থপতিদের তৈরি অট্টালিকায় ভরা। সেই প্রসঙ্গে বিবেকানন্দর মন্তব্য, ‘আমার ইচ্ছে করে, আমার চোখ দিয়ে তোদের সব দেখাই।... দেখ্‌ না— এই এত বড় বড় বাড়ি গভর্নমেন্টের রয়েছে, বাইরে থেকে দেখলে তার কোন মানে বুঝিস, বলতে পারিস? ...আমাদের জন্মভূমিটা ঘুরে দেখ। কোন্‌ বিল্ডিংটার মানে না বুঝতে পারিস, আর তাতে কি বা শিল্প।’ আর্ট আর ইউটিলিটি-র প্রসঙ্গে তিনি উদাহরণ দিয়েছেন, ‘ওদের জল খাবার গেলাস, আমাদের ঘটি— কোন্‌টায় আর্ট আছে?... পাড়াগাঁয়ে চাষাদের বাড়ি দেখেছিস?... তাদের ধানের মরাই দেখেছিস? তাতে কত আর্ট! মেটে ঘরগুলোয় কত চিত্তির-বিচিত্তির!... কি জানিস, সাহেবদের utility আর আমাদের art— ওদের সমস্ত দ্রব্যই utility আমাদের সর্বত্র আর্ট।’ আর্টের এই ঘর-গেরস্থালি প্রসারিত বুকভরা পাঠ বিবেকানন্দর আগে কেউ আমাদের দেয়নি। ভাবলে আশ্চর্য লাগে, একশো বছর আগেই এক ধর্মনেতা লোকশিল্পের কদর বুঝেছিলেন। অথচ দেশের তথাকথিত শিক্ষিতরা সেদিনও যে অবস্থানে ছিল, আজও তার বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। স্বামীজির অনুযোগ, ‘ঐ সাহেবী শিক্ষায় আমাদের অমন সুন্দর চুমকি ঘটি ফেলে এনামেলের গেলাস এসেছেন ঘরে। ওই রকমে utility এমন ভাবে আমাদের ভেতর ঢুকেছে যে, সে বদহজম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন চাই আর্ট ও ইউটিলিটি-র combination; জাপান সেটা বড় চট করে নিয়ে ফেলেছে, তাই এত শীঘ্র বড় হয়ে পড়েছে। এখন আবার ওরা তোমাদের সাহেবদের শেখাবে।’

কথ্য বাংলা চালে লেখা ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ রচনায় ঘা মেরেছেন, ‘এখনও দূর পাড়াগাঁয়ে পুরানো কাঠের কাজ, ইটের কাজ দেখে এসগে।’ পাড়াগাঁয়ে তখনও জীবনব্যাপ্ত শিল্পের হদিশ বিবেকানন্দ পেয়েছিলেন। সেই আর্টের সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় ঘটানোর জন্য মিসেস ওলি বুল-কে ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯০২ তারিখে বেনারস থেকে স্বামীজি লিখেছেন, ‘‘আমার একান্ত ইচ্ছা যে, আপনারা কয়েক ঘণ্টার জন্য কলকাতার পশ্চিমের কয়েকটি গ্রামে গিয়ে কাঠ, বাঁশ, বেত, অভ্র ও খড়ের তৈরি পুরাতন বাংলার চালাঘর দেখে আসুন। এই বাংলোগুলি অপূর্ব শিল্পনৈপুণ্যের নিদর্শন।’’

উক্ত চিঠিতে বিবেকানন্দ তাঁর গুণগ্রাহী জাপানি প্রাচ্যকলাবিদ ওকাকুরা-র কথা লিখেছেন। ওকাকুরা স্বামীজিকে জাপান নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। স্বামীজি লিখেছেন, ‘ওকাকুরা এখানে (বেনারসে) ভৃত্যদের ব্যবহারের একটি সাধারণ টেরাকোটার জলের পাত্র দেখতে পেয়েছিলেন। সেটির আকৃতি ও খোদিত কারুকাজ দেখে তিনি একেবারে মুগ্ধ।’

কলকাতার জুবিলি আর্ট অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও চিত্রশিল্পী রণদাপ্রসাদ দাশগুপ্তও বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দের মুখে শিল্পবিদ্যার কথা শুনে তাজ্জব! শশী হেসের কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত রণদাপ্রসাদের প্রতিক্রিয়া: ‘শিল্প সম্বন্ধে এমন জ্ঞানগর্ভ কথা এ জীবনে আর কখনও শুনিনি।’ রণদাপ্রসাদের সঙ্গে আলোচনার শেষে, স্বামীজি বেলুড় মঠে যে-ভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির তৈরি করার পরিকল্পনা করেছিলেন, তার নকশাও দেখান। বলেন, ‘এই ভাবী মঠ-মন্দিরটি নির্মাণে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য যাবতীয় শিল্পকলার একত্র সমাবেশ করবার ইচ্ছা আছে আমার। পৃথিবী ঘুরে গৃহশিল্প সম্বন্ধে যত সব idea নিয়ে এসেছি, তার সবগুলিই এই মন্দির নির্মাণে বিকাশ করার চেষ্টা করব।’

বিবেকানন্দই ভারতের প্রথম সন্ন্যাসী, যিনি পরপদানত ভারতের হয়ে বিদেশে ভারতের ধর্মধ্বজা উড়িয়েছেন, আবার জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে শুরু করে শিল্প-স্থাপত্যের খুঁটিনাটিও বিচার করেছেন। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের স্থাপত্যশিল্পের গুণগত ব্যবহারিক পার্থক্য হাজির করেছেন কখনও লেখায়, কখনও কথা-আলোচনায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE