Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বারুদ বিপদ

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ইঙ্গিত দিয়াছেন, শিক্ষকদের হাতে বন্দুক থাকিলে তাঁহারা হত্যাকারীকে পূর্বেই পাড়িয়া ফেলিতে পারিতেন, ফলে বন্দুক রাখিবার অধিকারই বরং বন্দুকবাজের সন্ত্রাস হইতে দেশকে মুক্ত করিতে পারে।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৮ ০০:০৩
Share: Save:

আমেরিকায় আবার একটি স্কুলে গুলি চলিল। এই বার টেক্সাস-এ। আট জন নিহত। দুই ব্যক্তিকে সম্ভাব্য অপরাধী হিসাবে গ্রেফতার করা হইয়াছে। ফেব্রুয়ারিতে ফ্লরিডায় এক স্কুলে এক প্রাক্তন ছাত্র গুলি চালাইয়া ১৭ জনকে মারিয়াছিল। তাহার পর প্রচুর ছাত্রছাত্রী, সাধারণ মানুষ আন্দোলন করিয়া বলিয়াছেন, ব্যক্তির বন্দুক রাখিবার অধিকার প্রত্যাহৃত হউক, ইহা নিরীহ মানুষের হত্যার কারণ হইতেছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ইঙ্গিত দিয়াছেন, শিক্ষকদের হাতে বন্দুক থাকিলে তাঁহারা হত্যাকারীকে পূর্বেই পাড়িয়া ফেলিতে পারিতেন, ফলে বন্দুক রাখিবার অধিকারই বরং বন্দুকবাজের সন্ত্রাস হইতে দেশকে মুক্ত করিতে পারে। আমেরিকায় এখন যেন নিয়ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে, কেহ নিজ জীবন লইয়া অসন্তুষ্ট থাকিলে, বিষাদে নিমজ্জিত হইলে, সহসা কয়েক জন নিরীহ মানুষের উপর গুলি চালাইয়া আক্রোশ চরিতার্থ করিবে। এই বিষণ্ণ বা ক্ষুব্ধ মানুষগুলির হাতের নিকটেই বন্দুক না থাকিলে, তাহারা হয়তো কাহারও উপর ঝাঁপাইয়া পড়িত, বা ছুরি লইয়া হামলা চালাইত, কিন্তু তাহাতে এত সংখ্যক মানুষ মারা যাইতেন না। হয়তো এমন ভয়াবহ বৃহৎ কাণ্ড আদৌ ঘটানো যাইবে না জানিয়া, উন্মত্ত লোকটি এই পরিকল্পনাই করিত না।

আমেরিকার সাধারণ মানুষের নিকট বন্দুক কোনও দূরতম বস্তু নহে। নিজ জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার্থে বন্দুক রাখিবার অধিকার মার্কিন সংবিধানে প্রদত্ত, এবং তাহা অনেকের মানসে এক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার। বহু মার্কিন জনপ্রিয় সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে, গুলিগোলা ছুড়িয়া সমস্যার সমাধান অতি প্রচলিত ঘটনা। সমাজের এই অনুমোদন হিংসাকে এক প্রকার বৈধতা প্রদান করে। হিংসাকে প্রধানত অপরাধ হিসাবে না দেখিয়া, বীরত্ব-দ্যোতক হিসাবে দেখা হইলে, শৈশব হইতেই মানুষের বন্দুকের প্রতি আকর্ষণ ও সম্ভ্রম জন্মাইয়া যায়, ভয় ও বিরাগ নহে। তাহার উপরে অাছে পাশ্চাত্য সমাজের কুখ্যাত একাকিত্ব, যাহা বর্তমান ভার্চুয়াল-জগতের আগ্রাসনে ক্রমবর্ধমান। পাশ্চাত্যে মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরকে সম্মান করা হয়, নিজ সন্তানের ঘরেও হুটহাট অনাহূত ঢুকিয়া পড়া চলে না। তাই পঞ্চদশবর্ষীয় ছেলেটি সারা দিন ঘরে বসিয়া কী ভিডিয়ো গেম খেলিতেছে, তাহাতে অসংখ্য মানুষকে নিধন করিলে প্রচুর পয়েন্ট সংগ্রহ করা যাইতেছে কি না, তাহা অভিভাবকদের গোচরে না থাকিতেই পারে। সে এই ভিডিয়ো চরিত্রগুলি ব্যতীত আর কাহারও সহিত মিশিতেছে কি না, বাস্তবের সহিত কোনও যোগ তাহার স্থাপিত হইতেছে কি না, সামাজিক জীবন না পাইয়া সে নিঃসঙ্গতার দ্বীপে নির্বাসিত কি না, ইহাও অনেকে বুঝিতে পারেন না, সদিচ্ছা থাকিলেও। বুঝিলেও তাহাকে সক্রিয় ভাবে বিষাদ হইতে স্বাভাবিকতার পরিসরে টানিয়া আনিবার প্রচেষ্টা, বা মনস্তত্ত্ববিদের নিকট লইয়া যাইবার প্রয়াসের অভাব ঘটে। এতগুলি সঙ্কটের মোকাবিলার পথ নির্ধারণ কঠিন। যে ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর পাশ্চাত্য সভ্যতা নির্মিত, সেই মহান ভিত্তি কি বন্দুক-হামলার ভয়ে গুঁড়াইয়া দেওয়া চলে? এই বার কি বাঙালি মধ্যবিত্ত মা-বাবার ন্যায় মার্কিন পিতামাতা বাথরুমে দ্বার ধাক্কাইবে, এত ক্ষণ কী করিতেছিস?

কিছু বন্দুক-সমর্থক ‌বাক্‌স্বাধীনতা-তর্কের প্রসঙ্গ তুলিয়াছেন। যদি কেহ বাক্যকে হিংসার প্ররোচনা দিবার জন্য ব্যবহার করে, রাষ্ট্র তাহাকে শাস্তি দিতে পারে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা রহিয়াছে— এই জুজু দেখাইয়া পূর্বেই বাক্‌প্রয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিলে, তাহা মৌলিক অধিকারের উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ। কিন্তু এই যুক্তিকে বন্দুক-তর্কে টানিয়া আনিলে, সেই প্রকাণ্ড টানাটানিতে যে সত্যটি গুলাইয়া যায়: বাক্যে মানুষ মরে না। এইখানে প্রাণ বিনষ্ট হইতেছে। হিংসা-প্ররোচক বাক্য যেখানে শাস্তিযোগ্য, সেখানে ইহা তো সরাসরি হিংসা! কাহারও মতে, বন্দুক রাখিবার অধিকার মার্কিন জীবনে অনেকের নিকট আত্মরক্ষার অধিকার, তাহা কাড়িলে নাগরিক নিজেকে বিপন্ন মনে করিতে পারেন। কিন্তু সেই বিপন্নতা তো তাঁহার মগজে বহু যুগ ধরিয়া প্রবিষ্ট করানো হইয়াছে। প্রশাসনকেই মানুষ যথেষ্ট রক্ষাকর্তা মনে না করিলে, তাহা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। এত মানুষের প্রাণহানির চরম বিপর্যয় অস্বীকার করিয়া, প্রথাগত বিপন্নতার বোধকে প্রশ্রয় দান ঠিক হইবে না। হিংসাপূজক মার্কিন ক্ষমতাবানেরা বারুদধূম্র সরাইয়া সত্য দেখিতে পাইবেন কি?

যৎকিঞ্চিৎ

অফিসে এত দিন অনুপস্থিত কেন, জবাবে গুজরাতের এক মধ্যবয়সি পুরুষ জানিয়েছেন, তিনিই কল্কি অবতার, বাড়িতে বসে তপস্যা করে ভারত উদ্ধার করছেন। হাসাহাসি চলছে। কিন্তু পৌরাণিক হিন্দুত্বের ধ্বজা ওড়াব, আবার কেউ নিজেকে অবতার বললে, অলৌকিক কাণ্ডে সক্ষম বললে ব্যঙ্গ করব, হয়? কর্নাটকে যা চলছে, এ-ই তো কল্কির আত্মঘোষণার ক্ষণ! তবে গুজরাত থেকে নতুন মিরাক্‌ল-মানুষ উত্থিত হলে, হিংসেয় যদি কারও ৫৬ ইঞ্চি ধড়ফড়ায়, অন্য কথা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Terrorism Terrorist Activity United States
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE