Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
এ বারের দলিত প্রতিবাদ নিয়ে বিজেপি পড়েছে মহা মুশকিলে

ইতিহাস অতি বিষম বস্তু

ইতিহাস মানে একটা বহুমুখো ধারালো অস্ত্র, যেটা নানা দিকে একসঙ্গে কাটাকাটি করে। যে ভাবছে করাতের এক কোপে এই সব জঞ্জাল সাফ করলাম, ভাবতে গিয়ে সে-ই আবার উলটে একই করাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ছে!

দাবিদার: বিক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ দলিত গোষ্ঠীর সদস্যরা রাস্তা জুড়ে মিছিলে হাঁটছেন, মুম্বই, ৩ জানুয়ারি। ছবি: রয়টার্স

দাবিদার: বিক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ দলিত গোষ্ঠীর সদস্যরা রাস্তা জুড়ে মিছিলে হাঁটছেন, মুম্বই, ৩ জানুয়ারি। ছবি: রয়টার্স

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:১৩
Share: Save:

দুমুখো করাত তবু ভাবা যায়, কিন্তু বহুমুখো করাত? আমরা কেউ কি দেখেছি এমন জিনিস? যেটা একসঙ্গে অনেক দিকে কাটে? দেখিনি তো? অথচ ইতিহাস বস্তুটার কথা ভাবলেই দেখতে পাব বস্তুটা, মনে মনে। ইতিহাস মানে একটা বহুমুখো ধারালো অস্ত্র, যেটা নানা দিকে একসঙ্গে কাটাকাটি করে। যে ভাবছে করাতের এক কোপে এই সব জঞ্জাল সাফ করলাম, ভাবতে গিয়ে সে-ই আবার উলটে একই করাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ছে! রাতদিন ইতিহাস নিয়ে যাঁরা লোফালুফি করছেন, তাঁরা তো একাই ইতিহাসের ইজারা নেননি, আশেপাশের লোকগুলোও যে মুখিয়ে আছে ইতিহাসকে ব্যুমেরাং-এর মতো তাঁদের দিকে উলটো ছুড়বার জন্য, তাঁরা সেটা মাথায় রাখেননি।

এ বারের ১ জানুয়ারি থেকে মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁও গ্রাম থেকে পুণে আর মুম্বই অবধি যে ভয়ানক সংঘর্ষ দেখলাম, তাতে ইতিহাসের ওই বহুমুখী দাঁতওয়ালা চেহারাটাই ফুটে উঠল। নয়তো, কে কবে শুনেছে ভীমা কোরেগাঁও-এর মতো নগণ্য অঞ্চলের নাম। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসের অত্যুৎসাহী পাঠক ছাড়া বিশেষ কেউ জানেনই না যে সেখানে একটি স্মারকস্তম্ভ আছে, ১৮১৮ সালে তৃতীয় অ্যাংলো-মরাঠা যুদ্ধে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও-এর বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ জয়ের মনুমেন্ট, কেননা ওই এক যুদ্ধে মহারাষ্ট্রে কোম্পানি বাহাদুরের বিরোধীরা সব ধুয়েমুছে সাফ হয়েছিল। এর সঙ্গে আরও একটা কথা বলে মরাঠি ইতিহাস— দুশো বছর আগের ওই যুদ্ধে ব্রিটিশ পক্ষে লড়েছিলেন মহার গোষ্ঠীর শ’পাঁচেক মানুষ, অর্থাৎ দলিত মানুষ, যাঁরা সে দিন ব্রিটিশদের হয়ে পেশোয়া বাজিরাও-এর বিরাট বাহিনীর থেকে জয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলেন, প্রাণও দিয়েছিলেন। ভীমা কোরেগাঁও মনুমেন্টের পাদদেশে যে যোদ্ধাদের নাম উৎকীর্ণ, তার মধ্যে ওই মহার ‘শহিদ’দের নামও আছে। স্তম্ভটি হয়তো অনাদরেই পড়ে থাকত, যদি না ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি বাবাসাহেব ভীমরাও অম্বেডকর দলিত জাগরণের লক্ষ্যে ওই স্মারকস্তম্ভের পায়ের কাছে পুষ্পস্তবক রেখে, কয়েকটি কথা বলে, স্থানীয় দুঃখী-অভাবী মানুষগুলিকে নতুন করে ভাবানোর চেষ্টা করতেন। বাবাসাহেবের জন্যই সে বছর থেকে শুরু হল ভীমা কোরেগাঁও উদ্‌যাপন। তখন থেকে বছরের প্রথম দিন দলিত মানুষের ভিড় জমে সেখানে, দু’একটা খুচরো বক্তৃতা, ফুলমালা দিয়ে অনুষ্ঠান সারা হয়।

ভাবতে গেলে একটু তালগোল পাকিয়ে যেতেও পারে। মহার ‘শহিদ’? দলিতরা তো ব্রিটিশ বাহিনীর পক্ষেই যুদ্ধ করেছিলেন, তবে ‘শহিদ’ হলেন কী করে? ব্রিটিশরা না হয় তাঁদের ‘শহিদ’ বললেন, কিন্তু অম্বেডকরের মতো ঘোর ব্রিটিশবিরোধীও সেখানে গিয়ে ‘শহিদ’-স্মরণে বক্তৃতা দিয়ে এলেন?

এইখানেই মজা। সে দিনের বক্তব্যে অম্বেডকর একটা ভারী জরুরি কথা বলেছিলেন। পেশোয়া সাম্রাজ্যের মতো ‘দুর্ধর্ষ দুশমন’-এর সঙ্গে লড়েও যে দলিতরা জিততে পারেন, অত্যাচারী উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেও যে সমাজের এক ধারে অনাদরে অনাহারে পড়ে থাকা নিম্নবর্ণের মানুষরা নিজেদের ক্ষমতা প্রমাণ করতে পারেন, সেটাই কি একটা মনে রাখার মতো কাহিনি নয়? স্বাধীনতার জন্য, নিজেদের সবল করার জন্য সেই কাহিনিটাকেই তো স্মরণ করা উচিত, ‘আমরাও পারি’ বিশ্বাসটা ইতিহাস থেকে চেঁচে তুলে আনা উচিত।

এইটুকুই বলেছিলেন তিনি। যা বলেননি, সেটা আমরা অনুমান করে নিতে পারি তাঁর অন্য লেখাপত্র থেকে। ভারত তো কেবল উচ্চবর্ণের হিন্দুর দেশ নয় যে তাদের গল্পগুলোই জাতীয়তাবাদের নামে প্রচার করা হবে! ভারতে আরও অনেক ‘জাতি’ আছে, যেমন দলিত জাতি, তাদের ইতিহাস গেল কোথায়? সে সব কি কেবল ঢাকাঢুকি চাপাচুপি দেওয়ার জিনিস? ১৮১৮ সালে ব্রিটিশের পক্ষে তারা যুদ্ধ করেছিল, কিন্তু সেটা তো কথা নয়, আসলে তারা লড়ছিল সে দিনের শাসকদের বিরুদ্ধে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ পেশোয়াদের নির্লজ্জ ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে: সেটা মনে না রাখলে চলে? শাসকের বিরুদ্ধে যারা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়, প্রাণ দেয়, তারাই তো শহিদ? বিশেষত যে শাসকরা দলিতদের মানুষ বলেই মনে করতেন না, মুসলমানদের থেকেও অধম ভাবতেন। পেশোয়ার হয়ে কাজ করত যে দলিতরা, তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে তার পর ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হত ‘নিচুজাত’ বলে। এই অপমানের শোধ তুলতেই তারা ব্রিটিশদের ভাড়াটে হয়ে লড়াই করতে নেমে পড়ে, এমনই বলছে লোককথা। এই আলো-আঁধারি ইতিহাসের সূত্র ধরেই পথ দেখিয়েছিলেন বাবাসাহেব। জাতীয়তাবাদের ব্রাহ্মণ ইতিহাসের বিরুদ্ধে দলিত ঐক্য ও আত্মপ্রত্যয়ের স্মারকটিকে মনে রাখতে বলেছিলেন। সেটাই ঘটছে প্রতি বছর ভীমা কোরেগাঁওতে।

কিন্তু প্রতি বছর ঘটছে বলেই এ বছরও ছেড়ে দেওয়া হবে, এমন তো বিজেপি হতে দিতে পারে না। দলিতরা বলে যাবে হম কিসিসে কম নহীঁ, আর ‘গুরু’ শম্ভাজি ভিডে, মিলিন্দ একবটে প্রমুখরা মুখই খুলবেন না? এখন না রাজ্যে কেন্দ্রে বিজেপি-সংঘের সুদিন গমগমায়মান? এই সুযোগে দলিতগুলোকে একটু শিক্ষা দেবেন না তাঁরা? এত বড় সাহস— পেশোয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতার দ্বিশতবার্ষিকী পালন? এমনকী পেশোয়াবাদের মহামহিম কেন্দ্র শনিবার-বড়া প্রাসাদ থেকে উৎসব শুরু? এ তো সোজাসুজি ‘প্রতিষ্ঠান হিন্দুস্তান’কে (শম্ভাজি গুরুদেবের আখড়াটির নামে এই দুই শব্দ শোভা পাচ্ছে) চ্যালেঞ্জ জানানো! ‘রে রে’ করে উঠলেন তাঁরা, উৎসবের আগের দিন, ৩১ ডিসেম্বর!

সে দিন কী হয়েছিল, সেটা একটু বলা দরকার। নয়তো যেন মনে হচ্ছে যে, উৎসব উদ্‌যাপন করতে গিয়ে দলিতরাই দাঙ্গা বাধিয়ে ফেললেন! আগের দিন কী হল যাতে পরের দিন এত লোক জড়ো হল? অন্য বছর যেখানে কয়েকশো লোকের বেশি হয় না, সেখানে হঠাৎ লাখখানেক লোক চলে এল?

প্রথম ফুলকিটা ধরেছিল পুণাতেই, ৩১ ডিসেম্বর বিকালে। দুশো বছর পূর্ণ হচ্ছে, তাই এ বার কয়েকটি দলিত গোষ্ঠী বড় করে উৎসব পালন করতে উৎসুক। শনিবার-বড়ার সামনে খোলা চত্বরটি বেছে নিয়ে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ করা হল গুজরাতের সদ্যবিজয়ী দলিত নেতা জিগ্নেশ মেবাণী ও জেএনইউ-খ্যাত উমর খালিদকে। বক্তা-নির্বাচনই বলে দেয়, বিজেপি-বিরোধিতার সুরটা ছিল যথেষ্ট চড়া, বর্তমান বিজেপি রাজকে জিগ্নেশ বললেন ‘নব্য পেশোয়াতন্ত্র’-এর মতোই অসহিষ্ণু দলিতবিরোধী। হিন্দুত্বের চেলাদের পক্ষে গণতন্ত্রের এই বিকল্প ব্যবহার সহ্য করা কঠিন, বিশেষত সাক্ষাৎ পেশোয়া-ভূমিতে। তেড়ে গেলেন তাঁরা, হুমকি মারপিটে সভা লন্ডভন্ড। পর দিন সকালে পুণা থেকে মিছিল রওনা হওয়ার কথা ভীমা কোরেগাঁওতে। উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ল, দেখা গেল, কয়েকশোর জায়গায় কয়েক হাজার মানুষ এসেছেন কাকভোরে। গোটা রাস্তা জুড়ে তাঁদের পেটানোর জন্য প্রস্তুত দলে দলে গেরুয়া ফেট্টি-ধারী চেলারা, হিংসা ছাড়িয়ে গেল সীমা। এখন অবশ্য বলা হচ্ছে উসকানিটা নাকি দিয়েছিলেন জিগ্নেশ-উমররাই, তাই তাঁদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়েছে।

উসকানি তো বটেই! বিজেপির বিরুদ্ধে কিছু বলা মানেই উসকানি, ‘বিজেপি হিন্দুত্বে’র বিরুদ্ধে অন্য কোনও স্বার্থ বা সত্তার কথা বলা মানেই ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’। এ সব তো চেনা গল্প। নতুন কথা এইটুকুই: রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে-পড়া দলিত-বিজেপি সংঘাতের মধ্যে মহারাষ্ট্রের ঘটনাটার একটা বিশেষত্ব আছে। শাসকের বিরোধী হলেই যে ‘শহিদ’ হওয়া যায়, আর সেই যুক্তিতে যে কোনও যুগে, আজও, হিন্দু অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেও গৌরবের জয় জেতা যায়, ইতিহাসের এই পালটা মারের জন্য প্রস্তুত ছিল না বিজেপি নেতৃত্ব। ছুটকোছাটকা মন্তব্য ভেসে আসছে ঠিকই ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পা-চাটা’ দলিতদের নিয়ে, কিন্তু নেতৃত্বাসীন নরেন্দ্র-দেবেন্দ্র-অমিতরা গলায় যেন অতটা জোর আনতে পারছেন না। শম্ভাজিরা যা-ই বলুন, হিন্দুত্ব প্রকল্প থেকে দলিতদের তো পিটিয়ে বাদ দেওয়া যাবে না, সংখ্যায় তারা অনেক, ভোটে তারা পরশপাথর। তার উপর তাদের এই উৎসব শুরু করেছেন স্বয়ং অম্বেডকর, যাঁকে ইতিমধ্যেই বিজেপি আইকন বানিয়ে পুজো করতে ব্যস্ত!

ফলে সাধু সাবধান! বাবাসাহেবের নাতি প্রকাশ অম্বেডকর মহারাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দলিত নেতা এই বারের আন্দোলনের পুরোভাগে। তাঁর মুন্ডুপাত করো। কিন্তু দলিত উৎসবের মুন্ডুপাত নিয়ে মেপে পা ফেলো, বাবাসাহেবের আশীর্বাদ ওতে!

তাই বলছিলাম, ইতিহাস জিনিসটা বড্ড ঝামেলার, নানা দিকে তার তীক্ষ্ণ দাঁত! এই বহু জন বহু সমাজের দেশে ইতিহাসের এমন দুমদাম ব্যবহার নিজেদের পক্ষে মঙ্গলজনক হচ্ছে কি না, একটু ভেবে নেবেন নাকি বিজেপি-বাবুরা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Dalit Protest Gujarat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE