Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

শূন্যতার গৌরব

ভারত-মার্কিন যুগ্ম বক্তব্যে পাকিস্তানের প্রতি কড়া বার্তা বর্ষিত হইয়াছে, ইহা তেমনই একটি বাহিরের কথা। ভিতরে যে কথাগুলি লুকাইয়া, তাহা হইল, বক্তব্যটির পরিবেশনাই বলিয়া দেয় যে পরবর্তী কালে আমেরিকার পিছাইয়া আসিবার অবকাশ যথেষ্ট।

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৭ ০০:৩০
Share: Save:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মার্কিন সফর প্রমাণ— তাঁহার কূটনীতিটি তাঁহার রাজনীতির সহিত অতি মাত্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাহাতে চাকচিক্য প্রভূত, সৌহার্দ্য প্রদর্শন নিরবচ্ছিন্ন। দেশের মন কি বাত-এর মতোই বিদেশের কূটনৈতিক বক্তৃতায় বাহিরের অলংকারগুলি ভিতরকার সারবস্তু অপেক্ষা অনেক গুণ জোরদার। তাই শেষ অবধি হাতে কতটুকু পড়িয়া থাকে হিসাব করিতে বসিলে শ্রোতা কিংবা দর্শকের ভগ্নহৃদয় হওয়ার আশঙ্কা বিস্তর। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী দুই হাত বাড়াইয়া আলিঙ্গন করিতেছেন, এই ছবি আপাতত দেশের সর্বত্র দৃশ্যমান। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই বুঝিতে দেওয়া হইয়াছে যে আলিঙ্গনটি পুরাদস্তুর একপাক্ষিক। ছবির পিছনের ঘটনা: ডোনাল্ড ট্রাম্প যে কেবল আলিঙ্গনে অনাগ্রহী ছিলেন তাহাই নয়, তিনি মোদীর আলিঙ্গনাকাঙ্ক্ষায় যথেষ্ট বিস্মিত ও বিব্রত। প্রেক্ষিতহীন ছবির মাধ্যমে ঘটনা-উত্তর ভিন্ন বাস্তব তৈরি করিবার প্রয়াসটি যে একান্ত ভাবে মোদী রাজনীতির একচেটিয়া, খেয়াল করা জরুরি। ভারত ইতিমধ্যে ইহার বহুবিধ দৃষ্টান্ত দেখিয়াছে, এই সফর সেই তালিকায় যুক্ত হইল। যে সফরের পর ভারতীয় কূটনীতিক মহলের মুখ হতাশায় ঝুলিয়া পড়িবার কথা, পোস্ট-ট্রুথ রাজনীতির দৌলতে সেই সফর এখন প্রধানমন্ত্রী মোদীর মুকুটের আর একটি নূতন পালক হিসাবে বৃত হইতেছে। কেন্দ্রীয় সরকার বাহিরের সাফল্য ও আড়ম্বর দেখাইয়া জাতীয়তার গৌরবে আটখানা। ভিতরের বাস্তবটি জানাইবার সময় কিংবা সততা তাঁহাদের কোথায়!

ভারত-মার্কিন যুগ্ম বক্তব্যে পাকিস্তানের প্রতি কড়া বার্তা বর্ষিত হইয়াছে, ইহা তেমনই একটি বাহিরের কথা। ভিতরে যে কথাগুলি লুকাইয়া, তাহা হইল, বক্তব্যটির পরিবেশনাই বলিয়া দেয় যে পরবর্তী কালে আমেরিকার পিছাইয়া আসিবার অবকাশ যথেষ্ট। এমনিতেই ট্রাম্পের কড়া পাকিস্তানবিরোধিতা লইয়া তাঁহার উপদেষ্টা-মহল অখুশি। তাঁহাদের মতে, ইসলামাবাদের উপর এতটা চাপ বাড়াইলে, প্রথমত, পাক সরকারকে সন্ত্রাসবাদীদের সামনে দুর্বলতর করিয়া দেওয়া হয়, দ্বিতীয়ত, আমেরিকার প্রতিপক্ষ চিনের দিকে ইসলামাবাদকে আরও ঠেলিয়া দেওয়া হয়। তদুপরি, ‘ভারত-শাসিত কাশ্মীর অঞ্চলে’ হিজবুল্লা নেতাকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী বলিবার অর্থ কাশ্মীরে ভারতের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার। এত দিন পর্যন্ত আমেরিকা যখনই এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করিয়াছে, ভারত প্রতিক্রিয়া দেয় নাই। মোদীর অত্যুৎসাহ এবং সূক্ষ্ম কূটনীতির অপারগতা ভারতকে সেই অবস্থান হইতে প্রথম বার সরাইয়া আনিল। কাশ্মীর লইয়া এত কথা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতীয় প্রেসিডেন্টের সাহচর্যে বলিয়া ফেলিলে আর একটি সংকটও গভীরতর হয়। এত দিন দিল্লি যাহাকে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা বলিয়া নিরবচ্ছিন্ন ভাবে দাবি করিয়াাছে, তাহা বহুপাক্ষিক হইয়া যাইবার পথটি খুলিয়া যায়।

ইহা যদি ভারতের পরোক্ষ পরাজয় হয়, প্রত্যক্ষ পরাজয়টি অর্থনীতিতে। মোদী-ট্রাম্প আদানপ্রদানে স্পষ্ট, দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি পুরাইবার পথটি ওয়াশিংটন প্রস্তুত করিয়াছে। কিন্তু ভারতের তরফে শিল্পকর্মী সংস্থান অর্থাৎ এইচ-ওয়ান বি ভিসা লইয়া যে দীর্ঘমেয়াদি সংকট, এই দফার কথোপকথনে তাহা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঔদাসীন্য/অনিচ্ছাই তাহার কারণ। অথচ পাকিস্তানকে এক হাত লইতে উদগ্রীব ট্রাম্পের সামনে দাঁড়াইয়া মোদীর নিজের তাসটি খেলিবার সুযোগ ছিল বইকি। প্যারিস পরিবেশ চুক্তি হইতে মার্কিন প্রস্থানের ফলে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওবামার সময়ে ভারত-মার্কিন বোঝাপড়াতেও পরিবর্তন আসিতে চলিয়াছে, কিন্তু মোদী সে বিষয়টি লইয়াও ঘাঁটান নাই। তিনি খালি হাতেই ফিরিয়াছেন। কেবল আলিঙ্গন-আবেশই সম্বল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE