Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

সাফল্যের নীচে

প্রণোদনার মাধ্যমে চালিত হওয়াই মানুষের ধর্ম। সুতরাং, ছেলেদের যদি পড়াইতে হয়, তবে তাহার প্রণোদনা চাই। ‘শিক্ষায় মনের দরজা-জানালাগুলি খুলিয়া যায়’, এমন ছদ্ম-দার্শনিক দায় এড়াইয়া যাওয়া যুক্তি নহে, প্রকৃত প্রণোদনা চাই।

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৭ ০০:০১
Share: Save:

আলো যদি আসে, অন্ধকার কি দূরে থাকিতে পারে? মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে আলোর রেখা স্পষ্ট। মেয়েরা অগ্রসর হইতেছে। একটি মেয়ে পরীক্ষায় প্রথম হইয়াছে, তাহাই একমাত্র কৃতিত্ব নহে— পরীক্ষার্থীর সংখ্যায় মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় বেশি। তাহাদের গড় ফলও আগের তুলনায় ভাল হইতেছে। এই আলোর বিপরীতে অন্ধকারও আছে— ছেলেদের মধ্যে স্কুলছুটের মাত্রা বাড়িতেছে। মেয়েদের সাফল্য সমাজের পক্ষে যতখানি ইতিবাচক, ছেলেদের পিছাইয়া পড়া তাহার তুলনায় কম বিপজ্জনক নহে। কেন মেয়েরা অধিকতর সংখ্যায় পড়িতেছে, আর কেন ছেলেরা মাঝপথেই পড়া ছাড়িতেছে, দুই প্রশ্নের উত্তরই অর্থনীতির পরিসরে মিলিবে। মেয়েদের নিকট পড়িবার ইনসেনটিভ বা প্রণোদনা আছে, ছেলেদের প্রণোদনা পড়া ছাড়িবার। কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প বহু পরিবারকে মেয়েদের স্কুলে পাঠাইতে, মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়াইতে প্রণোদনা জোগাইয়াছে, এমন অনুমান অহেতুক নহে। মেয়ে মাধ্যমিক অবধি পড়িলেই যদি নগদ টাকা পাওয়া যায়, তবে তাহাকে না পড়াইবার জন্য জোরদার যুক্তির প্রয়োজন হয়। পাশাপাশি, মাধ্যমিক পাশ করিলে অপেক্ষাকৃত ভাল পাত্র জুটিবে, ইহাও হয়তো একটি কারণ। অর্থাৎ, মাধ্যমিক পাশ করা মেয়েদের পক্ষে একটি জরুরি মাইলফলক। যে ছেলেরা শিক্ষার মাধ্যমে জীবিকা খুঁজিবে না, তাহাদের পক্ষে মাধ্যমিক ততখানিই অবান্তর। ভিন্‌ রাজ্যে রাজমিস্ত্রির কাজ পাইতে অথবা সোনার গহনার কারিগর হইতে গেলে মাধ্যমিকের কোনও গুরুত্ব নাই। তাহার জন্য যে দক্ষতা প্রয়োজন, তাহা কাজ করিতে করিতেই অর্জিত হয়। ফলে, মাধ্যমিকের জন্য অহেতুক সময় নষ্ট না করিয়া কাজে যোগ দেওয়াতেই তাহাদের লাভ।

প্রণোদনার মাধ্যমে চালিত হওয়াই মানুষের ধর্ম। সুতরাং, ছেলেদের যদি পড়াইতে হয়, তবে তাহার প্রণোদনা চাই। ‘শিক্ষায় মনের দরজা-জানালাগুলি খুলিয়া যায়’, এমন ছদ্ম-দার্শনিক দায় এড়াইয়া যাওয়া যুক্তি নহে, প্রকৃত প্রণোদনা চাই। যে জীবিকার তাড়না তাহাদের মাধ্যমিকের পূর্বেই স্কুল ছাড়িতে বাধ্য করিতেছে, শিক্ষাকে সেই জীবিকার সহিত জুড়িয়া লওয়া বিধেয়। বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থাটির অভিমুখ উচ্চশিক্ষার দিকে। ন্যূনতম স্নাতক স্তরের লেখাপড়া শেষ না করিলে পেশার ক্ষেত্রে শিক্ষার কার্যত কোনও গুরুত্ব নাই। এই ব্যবস্থাটিকেই ভাঙিতে হইবে। সকলের যে উচ্চশিক্ষা প্রয়োজন নাই, এই কথাটিকে স্বীকার করিতে হইবে। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পর পেশামুখি প্রশিক্ষণের ব্যাপক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এবং, দুই স্তরের প্রশিক্ষণের মধ্যেও ফারাক থাকা বিধেয়। ছেলেমেয়েরা যেন জানে, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করিলে যে সুযোগ পাওয়া সম্ভব, তাহা স্কুল ছাড়িয়া দিলে পাওয়া যাইবে না। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকিলে স্বভাবতই রোজগারের সুযোগও বাড়ে। অর্থাৎ, স্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণ করাকে সচ্ছলতর জীবনের শর্ত করিয়া তুলিতে হইবে। এবং, এই ব্যবস্থাটি লিঙ্গ-নিরপেক্ষ। কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হইলে তাহাতে ছেলেদের যেমন লাভ, মেয়েদেরও তেমনই। লিঙ্গ-নির্বিশেষে প্রত্যেকই পড়িবে, এই সেই পড়া সফল জীবিকা অর্জনে সহায়ক হইবে— এই পরিস্থিতি তৈরি না হওয়া অবধি আলো-অন্ধকারের খেলা চলিতেই থাকিবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

education system higher education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE