Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

বন্দুকের আওয়াজে

তাঁর ইচ্ছে ছিল তাঁর দেহাবশেষ শাল-সেগুন-মহুল ছায়াবৃত লালমাটিতে মিশে থাকুক। যে ইচ্ছেকে ভদ্রলোকেরা পাত্তা দিল না। কলকাতায় বুট আর বন্দুকের আওয়াজে মহাশ্বেতা দেবীর অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন হল।ম হাশ্বেতাদির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিনটা মনে পড়ে। ১৯৭৮। ‘প্রমা’র প্রয়াত সম্পাদক সুরজিত ঘোষের সঙ্গে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে বালিগঞ্জ স্টেশন রোডের ওঁর বাড়িতে। মলিন ম্যাক্সিতে স্তব্ধ সমুদ্রকল্লোল। ইনিই তিনি! অরণ্যের অধিকার, হাজার চুরাশির মা, স্তনদায়িনী, দ্রৌপদী, ভাত, জল-এর স্রষ্টা! হারমনিয়ামের মতো বেজে উঠেছিলাম। শোওয়ার ঘরেই লেখার টেবিল।

স্বপ্নময় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

ম হাশ্বেতাদির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিনটা মনে পড়ে। ১৯৭৮। ‘প্রমা’র প্রয়াত সম্পাদক সুরজিত ঘোষের সঙ্গে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে বালিগঞ্জ স্টেশন রোডের ওঁর বাড়িতে। মলিন ম্যাক্সিতে স্তব্ধ সমুদ্রকল্লোল। ইনিই তিনি! অরণ্যের অধিকার, হাজার চুরাশির মা, স্তনদায়িনী, দ্রৌপদী, ভাত, জল-এর স্রষ্টা! হারমনিয়ামের মতো বেজে উঠেছিলাম। শোওয়ার ঘরেই লেখার টেবিল। এ-রকম টেবিল আমি কোনও লেখকের দেখিনি। এক ধারে ট্রানজিস্টার রেডিও। লেখার সময় নাকি বিবিধ ভারতী চলতে থাকে। অন্য ধারে নানা রকম চাঁদা কাটার বিল, হ্যান্ডবিল ও পুস্তিকা, যাঁদের সঙ্গে তিনি সক্রিয় ভাবে জড়িত। যেমন, আদিম জাতি ঐক্য পরিষদ, ইটভাটা শ্রমিক সমিতি, বিড়ি শ্রমিক সংগঠন, বাউল-ফকির-দরবেশদের সংগঠনও আছে। মাঝখানে একটি লেখার প্যাড। প্যাডে তখন লেখা চলছিল, শবর লোধাদের অধিকার রক্ষার লড়াইতে শামিল হন।

অনেক বহুব্যবহৃত ভোঁতা শব্দের মতোই ‘লড়াই’ এখন একটি জার্গন। মহাশ্বেতা দেবীর জীবনে লড়াইটাই জীবনের চালিকাশক্তি। তাঁর লড়াই বহুবিধ। জীবন যাপনে, সমাজসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায়, সাহিত্যে, পত্রিকা সম্পাদনায় এবং আরও। ওঁর চরিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, ‘উলগুলানের শেষ নাই’, ‘একটা লড়াই শেষ না হতেই আরেকটা লড়াই আইসে পড়ে যে, হামি কি করব’। জীবনের শেষ লড়াইটা ছিল মৃত্যুর সঙ্গে। আট সপ্তাহের লড়াই শেষ আঠাশে জুলাইয়ে।

বহু বছর আগেই দেখেছি, শান্তিনিকেতনের মেলায় শবরদের হস্তশিল্পের দোকানে বসে হাসতে হাসতে নিজের শরীরের রক্তবাহী শিরায় নিজেই প্রবিষ্ট করাচ্ছেন ইনসুলিন। তার পর একটি কৌটো খুলে হাতের তেলোয় নানাবিধ বড়ি তুলে মুখে দিয়ে এক গ্লাস জল। বললেন, লজেঞ্চুস। তার পরই একটি বাবুইঘাসে বোনা চুবড়ি দেখিয়ে বললেন, এটা কিনে নিয়ে যা।

একটার পর একটা লড়াই করতে হয়েছে ছোটবেলা থেকেই। সচ্ছল সংসার ছেড়ে স্বেচ্ছায় বেছে নিলেন বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে অন্য এক সংগ্রামী জীবন। সেলস গার্লের কাজ করেছেন। ছোটখাটো ব্যবসাও। শিক্ষকতা করেছেন স্কুল ও কলেজে। ব্রিটিশ আমলের লোধা-শবররা অপরাধপ্রবণ জাতি ঘোষিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পরেও তা বহাল ছিল। একা লড়াই করে এটি রদ করালেন। আদিম জাতি ঐক্য পরিষদ গড়েছেন এবং লড়েছেন। এ লড়াই সারা ভারতে ছড়িয়ে গিয়েছিল। কখনও আইনি লড়াই, কখনও রাস্তায়। সাহিত্যে তো বটেই। দলিত মূক মানুষের না বলা কথা গর্জিত হয়েছে ওঁর মুখে। গর্জনটাও অর্জন করে নিতে হয়। যেটা বলেছেন, সেটাই লিখেছেন এবং করেছেন। লোধা শবরদের গণমননে তিনি মা। মুন্ডা ও সাঁওতালদের তিনি মারাংদাই (বড়দিদি)।

সত্তরের অভিঘাতে আমরা এক ঝাঁক লিখতে শুরু করেছিলাম। বাতাসে তখনও বারুদ গন্ধ। ক্ষতচিহ্নগুলি মসৃণ হয়নি তখনও। আমাদের প্রায় সবার লেখার মধ্যেই স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা ছিল। আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না, মহাশ্বেতাদি আমাদের জুড়েছিলেন।

আমাদের দুঃসাহসিক অভিযান ছিল তাঁর লেখা আখ্যানের কাছাকাছি পৌঁছনো।

ইতিহাসের পুনর্নিমাণ মহাশ্বেতার আখ্যান রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কখনও পুরনো ইতিহাসের অংশ প্রসঙ্গীকৃত হয়েছে। কখনও সমসাময়িক কাল দলিলীকৃত হয়েছে, কারণ বর্তমানেই স্থিত থাকে ভবিষ্যৎ ইতিহাসের উপাদান। লোকবৃত্ত থেকে পাওয়া উপাদানগুলিকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন তিনি। তাঁর মতে, এখান থেকেই বোঝা যায় সাধারণ মানুষ ঘটনাকে কী ভাবে দেখছেন ও ব্যাখ্যা করছেন। তাঁর আখ্যানের চরিত্ররা কেউ ব্যক্তিমাত্র নয়। কোনও শ্রেণি, কৌম বা সুবিধাবাদীদের প্রতিনিধি। তিনি আখ্যানের মধ্যে মিশিয়েছেন গান, কিংবদন্তি, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদি নানাবিধ লৌকিক উপাদান, তৎসহ দলিল, চিঠিপত্র, সংবাদপত্রের খবর, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি। সত্তর পরবর্তী আখ্যানকারেরাও আঙ্গিক হিসেবে এই ধারাটি পছন্দ করেছেন। যাঁরা অন্য ঘরানার লেখা লিখতেন, তাঁরাও কিছু লেখায় বিষয় ও অভিমুখ পরিবর্তন করেছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘গরম ভাত অথবা একটি নিছক ভূতের গল্প’, ‘দেবদূত অথবা বারো হাটের কানাকড়ি’ গল্পগুলি পড়ে এ কথা মনে হয়েছিল।

মহাশ্বেতার হাতে বাংলা সাহিত্যের চরিত্র বদল হয়ে গিয়েছিল। বিস্তৃত হয়েছিল ভূগোল। মহাশ্বেতা বলেছেন, ‘আমার বেশ কিছু গল্প একটি বিশেষ অঞ্চল নিয়ে লেখা। ওই অঞ্চলটিকেই আমি ভারতবর্ষ মনে করি।’ একটি শরীরকে বুঝতে ফোঁটামাত্র রক্তের স্লাইড দরকার হয়। তবে দৃষ্টিতে আণুবীক্ষণিকতা থাকা চাই।

মণীশ ঘটক প্রতিষ্ঠিত ‘বর্তিকা’ পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব নেন মহাশ্বেতা দেবী। ১৯৮০’তে। ছোট চাষি, খেতমজুর, সব্জিবিক্রেতা, মৎস্যজীবী, রিকশাওয়ালাদের দিয়ে নিজেদের জীবনের গল্প লিখিয়েছেন, গ্রাম সমীক্ষা করিয়েছেন, লোকবৃত্তের অনুসন্ধান করিয়েছেন। সেই সঙ্গে পুলকেন্দু সিংহ, শক্তিনাথ ঝা-দের মতো গবেষকরাও লিখেছেন।

১৯৮১ সালের দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে উনি যা লিখেছিলেন তার সারকথা হল, বর্তিকা চায় খেটে খাওয়া মানুষেরা সরাসরি নিজেদের কথা বলুক। নিজেদের গ্রাম সমীক্ষা নিজেরাই করুক। গ্রামবাসী, মূলবাসীরা নিরক্ষর হলেও প্রজ্ঞাবান। ওঁরাই আগলে রাখেন আঞ্চলিক ইতিহাস, লোকপুরান। ইংরিজি শিক্ষিত ‘ভদ্রলোক’রাও লাভবান হবেন। এই সব তথ্য ভবিষ্যৎ গবেষণায় কাজে লাগাতে পারবেন। ইংরিজি না জানা বাঙালি কেমন বাংলা লেখেন, তা-ও ভদ্রলোকদের জানা দরকার।

বর্তিকা সত্যিই প্রচলিত পত্রপত্রিকার ধারণাকে ভেঙে দিয়েছিল। মহাশ্বেতা ধারাবাহিক ভাবে ভারতে ভূমিদাসপ্রথার ইতিহাস লিখেছেন। গ্রামসমীক্ষা তো থাকতই। গ্রাম্য উৎসব, পালাপার্বণ, আত্মকথা, এ সবও। একটি সংখ্যায় এক সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী নিজের অপরাধ বিশ্লেষণ করেছেন। লিখেছেন প্রহ্লাদ ভুক্তা, পরমানন্দ সিং, ভরত মাহাতোরা। চুনী কোটালও লিখতেন। কখনও শবর-লোধা, বাউল-ফকির, সাঁওতাল-মুন্ডাদের নিয়ে বিশেষ সংখ্যা হত। কিছু প্রশ্নমালা দিয়ে উত্তর চাওয়া হত। সেই উত্তর ছাপা হত। প্রশ্নগুলি এ রকম: প্রয়োজনে কী ভাবে টাকা ধার করেন? কত সুদ দিতে হয়? দৈনিক মজুরি কত পান? সারা দিনে কী কী খান? রাজনৈতিক দল সম্পর্কে ধারণা কী? প্রতিটি সংখ্যার একটি পাতায় ছাপা থাকত: ‘এই সব পত্রপত্রিকা পড়ুন।’ নানা পত্রিকার নাম থাকত। অধিকাংশই মফস্সলি পত্রিকা।

বর্তিকা মহাশ্বেতারই প্রতিচ্ছায়া। বর্তিকারও কোনও পূর্বসূরি ছিল না। স্বনির্মিত। তিনি ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক সুবিধা নেননি। বরং শেষের দিকে ওঁকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁর অন্ত্যেষ্টিপর্বে বুটের শব্দে, বন্দুকের আওয়াজে তাঁকে ‘রাষ্ট্রীয় মর্যাদা’য় সম্মান জানানো হল। কিন্তু, তাঁর ইচ্ছে ছিল আগুনখেকো লালমাটিতে তাঁর নশ্বর দেহ জ্বলে উঠুক, তাঁর দেহাবশেষ শাল-সেগুন-মহুল ছায়াবৃত লালমাটিতে মিশে থাকুক। ১৯৯৫ সাল নাগাদ একটি শবরমেলার আমি উপস্থিত ছিলাম। এই অভিলাষ তিনি প্রকাশ্য সভায় ব্যক্ত করেছিলেন। শবররা তাঁদের মায়ের এই ইচ্ছের কথা জানতেন। যে ইচ্ছেকে ভদ্রলোকেরা পাত্তা দিল না। জানতে পারলাম, শুক্রবার যখন কলকাতায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা চলছে তখন কুদাগ্রামের শবররা চাকা নদীর ধারে ওঁর নামে রোপণ করলেন এক মহাবৃক্ষ সেগুন। মহাশ্বেতা বৃক্ষ হয়ে তাঁদের আশ্রয় দেবেন।

মহাশ্বেতার মৃত্যুতে একটি সাহিত্য-অধ্যায় শেষ হল, বলেন অনেকে। আমরা মনে করি, ওঁর ধারাটাই এখন মূলস্রোত। হতে পারে ক্ষীণতর, তবু এই স্রোতোধারাতেই তিনি বেঁচে আছেন।

বসাই টুডু বলেছিল, মরণ বোলায়ে কিছু নাই হে কমরেট, বাঁচাটা নিয়েই যত গোলমাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE