Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Editorial News

এই সঙ্কটের অবসান এখনই জরুরি, প্রথম বুঝল অসমই

বাবা-মায়ের প্রবীণ বয়সে তাঁদের দেখভাল করা, আগলে রাখা যে সক্ষম সন্তানের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য, তা এখন আইন করে বলে দিতে হচ্ছে, এই ছবি অনেকের কাছে দুর্ভাগ্যজনক ঠেকতে পারে। কিন্তু বাস্তবটা এখন এই রকমই।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:৫৬
Share: Save:

পথ দেখাল অসম। এক গুরুতর সামাজিক সমস্যা নিয়ে নিরন্তর দোলাচল ছিল। এ সমস্যার সমাধানে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ উচিত, নাকি অনুচিত, সে নিয়ে তর্কের কিনারা মিলছিল না। আর অপ্রীতিকর দৃষ্টান্তগুলোর তালিকা দিনে দিনে দীর্ঘ হচ্ছিল, হারেও বাড়ছিল বই কমছিল না। নিরসনটা যে অত্যন্ত জরুরি, অসমের সরকারই তা প্রথম বুঝল এবং বোঝাল। অসহায়, প্রবীণ বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখালে সন্তানকে মাশুল দিতে হবে এবং সেই মাশুলেই বাবা-মায়ের দেখভালের ব্যবস্থা হবে— প্রণাম বিল পাশ করিয়ে এমন আইনি বন্দোবস্তই পাকা করে ফেলল অসম। এ পদক্ষেপ ভাল, নাকি মন্দ, এ পদক্ষেপে সমস্যাটা নিয়ন্ত্রিত হবে, নাকি এর অপব্যবহার হবে, সে সব নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু, সে তর্ক পরের বিষয়। সমস্যাটা যে গুরুতর, অসমই প্রথম তা সরকারি ভাবে মানল। সমাধান খুঁজে বার করাটা যে অত্যন্ত জরুরি, অসমই তা সর্বাগ্রে উপলব্ধি করল। পদক্ষেপ করলে, তা যে সুনির্দিষ্ট দিশাতেই করা উচিত, দ্বিধার কোনও স্থান যে নেই, অসম সরকার তাও বুঝিয়ে দিল গোটা দেশকে।

অসমের প্রণাম বিল প্রসঙ্গে মত দু’রকমের হতে পারে। প্রথম মত— যে বাবা-মা সম্তানকে লালন-পালন করেছেন, বড় করেছেন, সেই বাবা-মা প্রবীণ হলে, তাঁদের প্রতিপালনের দায়িত্ব সন্তানকেই নিতে হবে। দ্বিতীয় মতটা এর ঠিক উল্টো হতে পারে। অর্থাৎ, সন্তান প্রশ্ন তুলতে পারেন, কেন প্রতিপালিত হওয়ার আশায় থাকবেন বাবা-মা? কেন নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে রাখবেন না তাঁরা? দুটো মতের কোনওটাই নতুন নয়। এই দুই মত নিয়ে চর্চা বা বিচার-বিশ্লেষণ দীর্ঘ দিনের। কিন্তু সেই কাটাছেঁড়া বা তর্ক শুধুমাত্র সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা ঐতিহ্যের গণ্ডির মধ্যেই চলছিল। ফলে ঔচিত্য আর অনৌচিত্যের দ্বন্দ্ব ও সংশয়ের মধ্যেই তা আটকে থাকছিল। সুস্পষ্ট আইনি নির্দেশ বা বিধান কিছু মিলছিল না। দু-একটা ঘটনা বিচ্ছিন্ন ভাবে বিচারালয়ের প্রাঙ্গণে গিয়ে পড়ছিল। তার প্রেক্ষিতে শুধু জানা যাচ্ছিল, কিছু মানুষ তাঁদের অসহায় বাবা-মায়ের প্রতি যথোপযুক্ত দায়িত্ব পালন করছেন না এবং আদালত এ সবের নিন্দা করছে, দায়বদ্ধতা পালনের নির্দেশ দিচ্ছে। আদালতের এই সব নির্দেশ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন মামলায় আদালতের বিভিন্ন নির্দেশ বন্দোবস্তটাকে কোনও সুনির্দিষ্ট রূপরেখায় পৌঁছে দিতে পারছিল না। সেই সুনির্দিষ্ট রূপরেখাটা তৈরির কাজে প্রথম অগ্রসর হল অসম সরকার। প্রণাম বিল পাশ করিয়ে তারা প্রবীণ বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়বদ্ধতাকে আইনি কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করে নিল। এ বিষয়ে অসম গোটা দেশের কাছে পথপদর্শক হয়ে রইল।

বাবা-মায়ের প্রবীণ বয়সে তাঁদের দেখভাল করা, আগলে রাখা যে সক্ষম সন্তানের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য, তা এখন আইন করে বলে দিতে হচ্ছে, এই ছবি অনেকের কাছে দুর্ভাগ্যজনক ঠেকতে পারে। কিন্তু বাস্তবটা এখন এই রকমই। আইন না করলে প্রবীণ নাগরিকরা যে প্রতিপালিত হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন, তা বেশ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এখন। এ বিষয়ে আইন করা উচিত কি না, তা নিয়ে সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিসরে বিতর্ক ছিল বিস্তর। বাবা-মা সন্তানের প্রতি বা সন্তান বাবা-মায়ের প্রতি কী ভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করবেন, তা নিতান্ত পারিবারিক পরিসরের বিষয়, এই পরিসরে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ হওয়া উচিত নয়, কারণ তা অনধিকার চর্চা হবে— অনেকেই এমন মনে করতেন বা করেন। কিন্তু প্রবীণ নাগরিক বা অসহায় নাগরিকের অধিকার সুনিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের কর্তব্য। তাই এ বিষয়ে আইন প্রণয়নকে অনধিকার চর্চা বলা যাচ্ছে না একেবারেই।

আমেরিকাকে এবং পশ্চিমের অন্য অনেক দেশকেই এখনও সভ্যতার পরাকাষ্ঠা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। তার সঙ্গত কারণও থাকতে পারে, সে বিতর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, সন্তান লালন-পালন সংক্রান্ত আইন অত্যন্ত কঠোর ওই দেশগুলিতে। সন্তানের প্রতি কোথাও যদি এতটুকু অবহেলা বা অনাচার-অত্যাচারের আভাস মেলে, তা হলে খুব কঠোর পদক্ষেপ হয় পশ্চিমের ওই সব দেশে। সে সব খবর যখন কানে আসে, তখন কি আমরা সেগুলিকে প্রশাসনিক অতি-সক্রিয়তা বা অনধিকার চর্চা বলি? কখনওই বলি না। সভ্য দেশের আইনি ব্যবস্থাপনা বলেই ধরে নিই। তা হলে অসমের এই আইনকে সাধুবাদ আমরা জানাব না কেন?

অসম যে বিল পাশ করিয়েছে, তা কিন্তু প্রশাসনের তরফে কোনও অতি-সক্রিয়তা বা অনধিকার চর্চা নয়। পরিবারের প্রতি তথা সন্তানের প্রতি যথোপযুক্ত দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে কেউ যখন বার্ধক্যে উপনীত হচ্ছেন, তখন যথোপযুক্ত সম্মানের জীবন যাপন করা তাঁর অধিকারের মধ্যে পড়ে। অসহায়তার সুযোগ নিয়ে পরবর্তী প্রজন্ম যদি সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাঁকে, তা হলে হস্তক্ষেপ করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। কারণ প্রত্যেক নাগরিককে তাঁর অধিকার পাইয়ে দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য। এত দিন রাষ্ট্র সেই কর্তব্য কিয়দংশে পালন করে আসছিল বিচার বিভাগের মাধ্যমে। কখনও আবার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের নিজস্ব রসায়নকে কাজে লাগিয়েও এ সবের মোকাবিলার চেষ্টা চলছিল— যেমন সালিশি বা রাজনৈতিক প্রভাব বা মধ্যস্থতা। সে সব ক্ষেত্রে সর্বদা সুবিচারই মিলছিল, এমনটা বলা যায় না। তাই একটা পুরোদস্তুর আইনি বন্দোবস্ত জরুরি ছিল, আইনসভাকে কাজে লাগিয়ে এর সমাধান খোঁজার দরকার ছিল। অসমকে সাধুবাদ, কাঙ্খিত পদক্ষেপটা অসমই প্রথম করল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE