Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ভুল দেখিলেই

শহরের মূর্তিগুলির প্রতি তাঁহার বিলক্ষণ আগ্রহ আছে। এই আগ্রহ মাঘ মাসে কালবৈশাখীর ন্যায় আচমকা উদয় হয় নাই। বরং দীর্ঘ দিন ধরিয়াই তিনি শহরের মূর্তিগুলির উপর নজরদারি করা এবং তাহাদের নানাবিধ ত্রুটি সংশোধনের কাজটি স্বেচ্ছায় বাছিয়া লইয়াছেন।

শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

মূর্তির নেহাত প্রাণ নাই। থাকিলে কলিকাতা শহরের মূর্তিরা আজ বড় আশ্বস্ত হইত। আশ্বস্ত হইত ইহা জানিয়া যে, মূর্তি-রাজনীতির কারবারিদের ভরা বাজারেও এমন কেহ কেহ আছেন, যাঁহারা মূর্তিদের নিছক কার্যসিদ্ধির মাধ্যম হিসাবে নহে, বরং কিছু অন্য রকম চক্ষে দেখিয়া থাকেন। এমনই এক ছক-ভাঙা মানুষ মধুসূদন মাজি। শহরের মূর্তিগুলির প্রতি তাঁহার বিলক্ষণ আগ্রহ আছে। এই আগ্রহ মাঘ মাসে কালবৈশাখীর ন্যায় আচমকা উদয় হয় নাই। বরং দীর্ঘ দিন ধরিয়াই তিনি শহরের মূর্তিগুলির উপর নজরদারি করা এবং তাহাদের নানাবিধ ত্রুটি সংশোধনের কাজটি স্বেচ্ছায় বাছিয়া লইয়াছেন। এই কাজের জন্য তিনি বেতন পান না, প্রচার পান না, সরকারের তরফ হইতে অঢেল প্রশংসা, পুরস্কারও নিশ্চয়ই পান না। তবুও তিনি কাজটি করিয়া থাকেন। কারণ, তাঁহার কাছে মূর্তিগুলি দেশের ‘সংস্কৃতি’র অঙ্গ। তিনি সেই সংস্কৃতিকেই সসম্মানে রক্ষা করিতেছেন মাত্র।

অনস্বীকার্য যে, শুধুমাত্র বিখ্যাত ব্যক্তিদের মূর্তি সংশোধন করিলেই দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষিত হয় না। এবং সেই সংস্কৃতি রক্ষা করিবার মহৎ কাজটিও শুধুমাত্র মধুসূদন মাজির ন্যায় অ-রাজনৈতিক মানুষরাই করেন না। বিবিধ রাজনৈতিক দলও তাহা মহা আড়ম্বরেই করিয়া আসিয়াছে। এখনও করিতেছে— আড়ম্বর ও হুংকার দুইই চোখে পড়িবার মতো বৃদ্ধিও পাইয়াছে। ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’ বলিতে ঠিক কী বুঝায়, তাহা নিজ দলীয় ফরমান অনুযায়ী ব্যাখ্যা করিয়া সেই মোতাবেক রক্ষা করা হইতেছে। সেই সংস্কৃতির নানা মাপকাঠি। যথা, মহিলাদের খাটো পোশাক দেশীয়-সংস্কৃতি বিরোধী। সুতরাং, খাটো পোশাক পরিহিতাদের হেনস্তা করিয়া সংস্কৃতি রক্ষা চলিতেছে। অন্য ধর্মে, অন্য জাতে বিবাহ করা দেশীয় সংস্কৃতি বিরোধী, রক্ষকরা সেই বিরোধী-সমুদয়কে উচিত শিক্ষা দিয়া সংস্কৃতির মান রক্ষা করিতেছেন। শিক্ষা হইতে বিনোদন— সর্বত্র গেরুয়া রং বুলাইবার কর্মযজ্ঞ তো আছেই। অপছন্দের মূর্তি ভাঙিয়াও সেই সংস্কৃতি রক্ষারই জোরদার প্রয়াস চলিতেছে।

মধুসূদনবাবুরা সংস্কৃতি বলিতে অন্য জিনিস বুঝেন। তিনি সংস্কৃতিকে রক্ষা করিতে চাহেন নিরন্তর সংশোধনের মাধ্যমে। প্রকৃতপক্ষে, ‘সংস্কৃতি’ শব্দটির উৎপত্তিও ‘সংস্কার’ হইতে, অর্থাৎ সংশোধন। সুতরাং, তাঁহার উদ্দেশ্যপূরণের পথটি যথাযথ। শুধুমাত্র সংস্কৃতি কেন, যে-কোনও বিষয়, এমনকী সমাজকেও যুগোপযোগী এবং প্রাসঙ্গিক করিয়া তুলিতে সংশোধনই একমাত্র পথ। প্রয়োজনমাফিক, স্বার্থগন্ধী সংশোধন নহে। সৎ ও ইতিবাচক সংশোধনের এক তাড়না এই ক্ষেত্রে বড় জরুরি। এবং জরুরি মধুসূদনের মতো কিছু মানুষ, যাঁহারা সমাজের সমস্ত খুঁটিনাটি ভুলত্রুটিকে চিহ্নিত করিয়া তাহা মেরামতের জন্য প্রাণপাত করিবেন। একমাত্র তাহা হইলেই যে বৃহৎ ত্রুটিগুলি এত কাল অগ্রাহ্য করা হইয়াছে, তাহা হইতে মুক্তির পথ মিলিবে। ভদ্রতা, সদাচার, সহিষ্ণুতা— যে কোনও সভ্য সমাজে যাহা অত্যাবশ্যক, তাহা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইবে। সভ্যতা, গণতন্ত্রের মতোই, নিরন্তর সতর্ক রক্ষণাবেক্ষণ দাবি করে। তাহার শর্তগুলিকে তুচ্ছ করিয়া সবই ‘চলিতেছে, চলুক’ ভাবিলে অসভ্যতাই নিয়ম হইয়া দাঁড়ায়। যেমন এই দেশে, এই রাজ্যে। মধুসূদনবাবুর দৃষ্টান্ত ব্যতিক্রমী, সুতরাং মূল্যবান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE