Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

সংস্কারমুক্ত মন যেন ‘বহিরাগত’

আর তা শুরু হচ্ছে যে বাক্যটি দিয়ে তা ডুবে আছে প্রথমে উদ্ধৃত বাক্যটির বিপরীত মেরুতে এক গভীর সংলগ্নতার বোধে। ‘আজও মা বেঁচে।’

আলজিরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম, একটি দৃশ্য

আলজিরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম, একটি দৃশ্য

তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০৬:০০
Share: Save:

ফ্রান্সকে উপলক্ষ করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২০১৮-র কলকাতা বইমেলা। এ প্রসঙ্গে একটি সাম্প্রতিক বইয়ের কথা বলতে চাইছি যা খুঁড়ে তুলছে আধুনিক ফরাসি মননের নীচে শায়িত এক পুরনো ঔপনিবেশিক কঙ্কাল।

‘আজ মা মারা গেল। না কি গতকাল? কে জানে?’ আলব্যার কাম্যু-র ১৯৪২-এ প্রকাশিত উপন্যাস ‘বহিরাগত’-র (L’Etranger) মুখবন্ধে এই অব্যর্থ বাক্যটি এক লহমায় পাঠককে কাহিনির একদম মর্ম-মূলে প্রবেশ করিয়ে দেয়। আমরা বুঝতে পারি রচনার কথক-চরিত্র ম্যরসো (Meursault) কেন এক ‘বহিরাগত’। সহসা মোহ কেটে গেলে, আলো নিভে গেলে এ সংসারে নিজেকে বহিরাগতর মতোই মনে হয়। জীবনের থেকে মানুষের, মঞ্চের থেকে অভিনেতার এই যে বিচ্ছেদ, একেই বলে ‘অ্যাবসারডিটি’, অর্থশূন্যতার বোধ। আলজিরিয়ার লেখক কামেল দায়ুদ এই একই কাহিনির পুনর্নিমাণ করেছেন ‘ম্যরসো, বিরুদ্ধ সাক্ষ্য’ (Meursault, contre-enquête) উপন্যাসে। আর তা শুরু হচ্ছে যে বাক্যটি দিয়ে তা ডুবে আছে প্রথমে উদ্ধৃত বাক্যটির বিপরীত মেরুতে এক গভীর সংলগ্নতার বোধে। ‘আজও মা বেঁচে।’

কাম্যুর উপন্যাসের চরিত্র ম্যরসো আলজিরিয়ার সমুদ্রতীরে জনৈক ‘আরব’কে বেমক্কা খুন করে বসে। এই ঘটনার পিছনে আছে এক নারী-ঘটিত ঈর্ষা ও রেষারেষির গল্প। এই সব গল্পের ছুতোনাতায় লেখকের আসল অভিসন্ধি তাঁর ‘অ্যাবসারডিটি’র তত্ত্বটিকে খাড়া করা। বস্তুত, রচনা জুড়ে এই দার্শনিক তত্ত্বের উন্মীলনটিই প্রকট ও প্রধান, তার পিছনের দৈনন্দিন ঘটনা-প্রবাহ প্রচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট, যেন তা নেহাতই গৌণ। নির্বেদ-আক্রান্ত ম্যরসোর তো আর নিজস্ব কোনও দায় বা অ্যাজেন্ডা থাকতে পারে না জীবনে। গুলি করে কাউকে হত্যা করার মতো প্রয়োজনীয় আবেগ তার মনে আসবে কোত্থেকে? অতএব, তার পিস্তলের ট্রিগারে দৈবাৎ চাপ পড়ে গিয়েছিল। এবং গুলি ঠিকরে বেরিয়ে যদি কারও হত্যা হয়েই থাকে তো তার দায় সমুদ্র বা সূর্যের মতো কিছু প্রাকৃতিক অনুঘটকের বা সেই ঈশ্বরের, যার কোনও অস্তিত্ব নেই ম্যরসোর জীবনে। সোজা কথায়, এটি হত্যা নয়, দুর্ঘটনা। পশ্চিমি সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই হল ‘বহিরাগত’-র প্রতিষ্ঠিত পাঠ-প্রতিক্রিয়া। কাম্যুর অন্য অনেক কাহিনির মতো এই গল্পও নিহিত ঔপনিবেশিক পটভূমিতে। ১৮৩০ থেকে ১৮৬২, কাম্যুর জন্মভূমি আলজিরিয়া ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ। পরবর্তী কালে এই ঔপনিবেশিক পাঠের প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে অন্য আর এক উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রতি-পাঠক্রিয়া। এডওয়ার্ড সাইদের মতো তাত্ত্বিকরা ম্যরসোর এই সর্বাত্মক নির্বেদের নীচে চিহ্নিত করেছেন উপনিবেশক-মনের উপনিবেশ বিয়োগের বিষাদ। তাঁদের দাবি, উপন্যাসটিকে পড়তে হবে ঔপনিবেশিক ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে।

কামেল দেখাচ্ছেন, শুধু খুন নয়, নিজেকে দার্শনিক সংকটের বলিপ্রদত্ত প্রমাণ করে কী ভাবে বিশ্বখ্যাত হয়ে উঠল এক আততায়ী (ম্যরসো) আর প্রকৃত বলি তলিয়ে গেল ‘আরব’ নামের এক অনির্ণেয় পরিচয়ের নীরবতায়। হ্যাঁ, ম্যরসো দু’বার খুন করল একটি মানুষকে। প্রথমে তার শরীরকে। তার পর তার আত্মাকে, আত্ম-পরিচয়কে। নিহত মানুষটি কি ‘আরব’ ছিল? আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কোর মানুষ বার্বার জনগোষ্ঠীর লোক। তারা কথা বলে হয় বার্বার ভাষায়, নয়তো আরবি ভাঙা এক ভাষায়। কেন এই অপরিচয়ের অবহেলা? কামেল বলছেন, দেশীয় বলিটি জানত না ঘাতক সাহেবের দেশের ভাষা। অতএব ‘ঘটনাটিকে পুনর্লিখিত হতে হবে এক (ঘাতকের) ভাষায়, কিন্তু ডান থেকে বাঁ দিকে। অর্থাৎ তার দেহটা যখন জীবিত ছিল তখন থেকে সময়ের অলিগলি বেয়ে পরিসমাপ্তিতে পৌঁছনো অবধি।’ ‘তারও ঘর-গেরস্থালি’ ছিল। ছিলেন মা, ছিল ছোটভাই হারুন। হারুন, যে দস্তুরমত রপ্ত করবে ঘাতকের ভাষাটি, আর তার বয়ানেই আমরা শুনব মৃত দাদা মুসার গল্প। ‘স্বাধীনতার পর লোকেরা যেমন করেছে, আমি তা-ই করব; সাহেবদের ছেড়ে যাওয়া বাড়ির পাথর একটা একটা করে খুলে নিয়ে বানাবো আমার নিজের বাড়ি, নিজের ভাষা।’ (ম্যরসো, বিরুদ্ধ সাক্ষ্য)

আলজিরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের ১২ বছর আগে ঘটে এই হত্যাকাণ্ড। ফলত মুসা নিজের দেশে শহিদের মর্যাদাটুকুও পায় না। ও দিকে সুদীর্ঘ অপেক্ষার পর নিরীহ এক ফরাসিকে মেরে হারুন যখন ১৯৬২-তে দাদার খুনের শোধ নেয়, দেশ তখন সদ্য স্বাধীন। বীরের সম্মান দূরে থাক, তার কপালে জোটে স্বাধীন আলজিরিয়ার পুলিশি রাজের হাতে অপমান। কাহিনি রওনা দিয়েছিল যে দিক লক্ষ্য করে, শেষ পাঁচ পাতায় এসে অপ্রত্যাশিত বাঁক নিল একেবারে উলটো দিকে। সমালোচনার লক্ষ্য ঔপনিবেশিক অপরের থেকে ঘুরে গেল নিজের সমাজ, নিজের দেশের দিকে। আর এখানেই যেন আখ্যানটি অন্যান্য সমগোত্রীয় উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রতি-আখ্যানের থেকে আলাদা হয়ে গেল।

মুসার হত্যার সময় হারুন সাত বছরের শিশু। এখন সে প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধ। ‘ইমাম চেষ্টা করল আমার সঙ্গে ঈশ্বর নিয়ে কথা বলতে। সে বলল, আমি বৃদ্ধ এবং অন্যদের মতো আমার অন্তত প্রার্থনাটা করা উচিত। আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, সময় এত কম আমার হাতে যে ঈশ্বরের সঙ্গে তা নষ্ট করতে চাই না।’ আর ঈশ্বর বিষয়ে পাদরির প্রশ্নের উত্তরে ম্যরসো বলেছিল, এ সবে তার মোটেই আগ্রহ নেই, এবং ‘যাতে আমার আগ্রহ নেই তাতে আগ্রহী হওয়ার মতো সময়ও আমার হাতে বিশেষ নেই।’ উপন্যাসের প্রথম ভাগে দুটি কাহিনির পরস্পরবিরোধী অবস্থান থেকে, দ্বিতীয় ভাগে এসে এক বিন্দুতে মিলিত হল। হারুনের মধ্যে আমরা ম্যরসোকে আবিষ্কার করলাম।

হারুন ও ম্যরসো, দু’জনেরই সমালোচনার লক্ষ্য ধর্ম ও রাষ্ট্র। দু’জনেরই চেতনায় সৃষ্টিশীল বিদ্রোহ। বিপ্লব নয়, বিদ্রোহ। সমষ্টির নয়। ব্যক্তির। কোনও পূর্বকল্পিত পরিকল্পনামাফিক, কার্যক্রম-অনুসারী নয়। বরং তা ঘটনা বা পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তনশীল। সোজা কথায়, দু’জনেরই স্বাধিকারকামী সংস্কারমুক্ত মন, যে মন সদাই প্রশ্ন তোলে, সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদ করে।

কামেল দায়ুদের জন্ম ১৯৭০-এ। পরিবারে প্রথম আলোকপ্রাপ্ত। স্বদেশে স্বৈরতন্ত্র ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাঁর নিরন্তর মসিযুদ্ধ। বেপরোয়া এই সাংবাদিকের অনুগামী ও শত্রুর অভাব নেই। সংবাদপত্রে লিখতে লিখতেই প্রথম উপন্যাস ‘ম্যরসো, বিরুদ্ধ সাক্ষ্য’-এর পরিকল্পনা। প্রথমে আলজিরিয়ায়, পরে ফ্রান্সে প্রকাশিত। দেশে-বিদেশে সমাদৃত এই বইয়ের এক বছরে লক্ষাধিক কপি বিক্রি। মাত্র দুই ভোটের ব্যবধানে ফ্রান্সের সব থেকে নামজাদা ‘গোঁকুর’ পুরস্কার ফসকে যায়। তবে শ্রেষ্ঠ প্রথম উপন্যাসের গোঁকুর পুরস্কার করায়ত্ত হয়। ইউরোপ পেরিয়ে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে মার্কিন দেশে। তবে বিদেশের মাটিতে তাঁর এই সাফল্যের ফলে প্রত্যাশিত ভাবে স্বদেশে দুর্নামও জোটে। আলজিরিয়ার উদার বাম-গণতান্ত্রিক মহলে অনেকের মতো, কামেল পশ্চিমের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর মৌলবাদ-বিরুদ্ধতা প্রকারান্তরে পশ্চিমের ইসলাম-ভীতিকে ইন্ধন জোগায়। এ দিকে যেমন পশ্চিম দুনিয়া তাঁর কলমের সামনে আক্রান্ত বোধ করে, তেমনই মৌলবাদীদের কাছে তিনি ইজরায়েলের দালাল হয়ে ওঠেন।

পূর্ব ও পশ্চিম, দুই বিশ্বেরই সাংস্কৃতিক অধিবাসী কামেল দায়ুদ। তাই দুই বিশ্বেই তিনি ‘বহিরাগত’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE