Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

কথা ও কাজ

বিদেশিরা এই রাজ্যে কোনও দায়িত্ব নির্বাহ করিতে আসিলে, ফিরিয়া যান দুইটি মাত্র বাংলা শব্দ শিখিয়া: ‘হইবে না’। কারণ এইখানে সকল শ্রমিক, সকল ইউনিয়ন-নেতানেত্রী নাকি এই শব্দ দুইটি জপমালার ন্যায় ব্যবহার করেন।

শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:২৫
Share: Save:

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্য রাজ্যে কর্মরত পশ্চিমবঙ্গীয় শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন, তাঁহারা এই রাজ্যে ফিরিয়া আসুন। তাঁহার আশ্বাস— এমন কেহ যদি ফিরিয়া আসিতে চাহেন এবং সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকের নিকট নাম লিপিবদ্ধ করেন, তাঁহাকে এককালীন পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়া হইবে এবং তাঁহার জন্য এক শত দিনের কাজ নিশ্চিত করা হইবে, দুই শত দিনের কাজও দেওয়া যাইতে পারে। রাজস্থানে এক বাঙালি শ্রমিকের হত্যা, কেরলে এক বাঙালি শ্রমিকের রহস্যমৃত্যুর প্রেক্ষিতে এই ঘোষণা অত্যন্ত দরদি। মুখ্যমন্ত্রী এই ভাবে রাজ্যের শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াইলে, তাঁহার সহমর্মিতায় শ্রমিকরা আপ্লুত হইবেন, সন্দেহ নাই। এই ঘোষণাগুলির মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী এই বার্তাও দিয়াছেন যে অন্য রাজ্যের তুলনায় এই রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি অধিক উন্নত, এবং এই রাজ্যে জাতিবিদ্বেষ বা সাম্প্রদায়িকতাও প্রবল উগ্র রূপে বর্তমান নহে।

কিন্তু মূল আহ্বানটি কিঞ্চিৎ সমস্যাপূর্ণ। কারণ কথাটি শুনিয়া মনে হইতেছে, এই রাজ্যে কাজের অভাব নাই, ফিরিয়া আসিলেই তাহা পাওয়া যাইতে পারে। প্রত্যাবর্তন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আনন্দময়, কিন্তু যে আশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া তাহা ঘটিবার সম্ভাবনা, সেইটিই বেঠিক হইলে, কাহিনি শুভ উপসংহারের দিকে গড়াইবে না। এই রাজ্য হইতে বহু শ্রমিক অন্য রাজ্যে পাড়ি দিয়াছেন ও দিতেছেন বাধ্য হইয়া, এইখানে যথেষ্ট কর্মসংস্থান নাই বলিয়াই। তাহা না হইলে নিজ পরিবার-পরিজন ছাড়িয়া অন্যত্র যাইবার কথা কেনই বা কেহ ভাবিবেন? এই রাজ্যে শিল্প অপ্রতুল, বেকার সমস্যা প্রবল, সেই কথা আলোচিত হইতে হইতে পুরাতন হইয়া গিয়াছে। পূর্বের বামফ্রন্ট সরকার এই সংকটের জন্য অবশ্যই দায়ী, কিন্তু বর্তমান সরকারও দায় এড়াইতে পারে না। এই সরকার ঘটা করিয়া বহু শিল্প সম্মেলন করিয়াছে, মুখ্যমন্ত্রী নিজে বহু উদ্যোগপতির সহিত দেখা করিয়াছেন, বিদেশযাত্রাও করিয়াছেন এই কারণে। বহু বার তিনি বলিয়াছেন, পশ্চিমবঙ্গ বিনিয়োগকারীদের নিকট পরম অভীষ্ট গন্তব্য বলিয়া বিবেচিত হইবার যোগ্য, কিন্তু সেই শুষ্ক কথায় তেমন ফল হয় নাই। এই রাজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি শিল্পের অনুকূল নহে— সেই ধারণাই দেশে-বিদেশে বিদ্যমান।

প্রচলিত রসিকতা: বিদেশিরা এই রাজ্যে কোনও দায়িত্ব নির্বাহ করিতে আসিলে, ফিরিয়া যান দুইটি মাত্র বাংলা শব্দ শিখিয়া: ‘হইবে না’। কারণ এইখানে সকল শ্রমিক, সকল ইউনিয়ন-নেতানেত্রী নাকি এই শব্দ দুইটি জপমালার ন্যায় ব্যবহার করেন। কাজ করিবার তুলনায় কাজ না-করিবার ও কাজ পণ্ড করিবার উৎসাহ তাঁহাদের অধিক। যদি মুখ্যমন্ত্রী এই সকল কথাকেই মিথ্যা রটনা বলিয়া উড়াইয়া দিতে চাহেন, পূর্বে তাঁহাকে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প রাজ্যে আনিয়া দেখাইতে হইবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করিতে হইবে। তেলেভাজা শিল্পের উপর বরাত দিয়া, ভিনরাজ্যে পাড়ি দেওয়া শ্রমিকদের ডাকিতে থাকিলে হইবে না। কারণ মাতৃক্রোড়ে ফিরিয়া আসিবার প্রস্তাব বিলক্ষণ আবেগবর্ধক, কিন্তু সেইখানে অনাহারে থাকিবার সম্ভাবনাটি তেমন উদ্দীপক নহে। কেবল ভাল শুনিতে লাগিবে বলিয়া আহ্বানবাণী রচনা করা বুদ্ধিবিরোধী। কেহ কেহ তো ওই আহ্বানে বিশ্বাসও করিয়া বসিতে পারেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengal Industry Labours Mamata Banerjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE