Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

পাকিস্তানের ভূত

অবশ্য এই সবই যুক্তি-বুদ্ধির কথা। যাঁহারা ‘সংখ্যালঘুর সহায়তা’ শব্দবন্ধের মধ্যেই নিশ্চিত ভাবে, সম্মেলক ভাবে পাকিস্তানের ভূত দেখিবার জন্য বসিয়া আছেন, তাঁহাদের প্রতি এহেন যুক্তিবাক্য বর্ষণ নেহাত সময় নষ্ট।

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

স হায়ক দূরভাষ সংযোগ। সহজ ভাষায়, হেল্পলাইন। দেশের সংখ্যালঘুরা যদি কোনও ধরনের অত্যাচারের সামনাসামনি হয়, সে ক্ষেত্রে সরাসরি দূরভাষে যোগাযোগ করিবার প্রস্তাব। ইহাকে কি বিচ্ছিন্নতাবাদ বলা চলে? প্রস্তাবটিকে ‘পাকিস্তানের ভাষা’ বলা চলে? গুরুতর অভিযোগটি উঠাইয়াছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা সুরেন্দ্র জৈন, এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার সহিত গলা মিলাইয়াছেন পরিষদের সদস্য ও মুখপাত্রবৃন্দ। তাঁহাদের তীব্র ক্ষোভ, কেন জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের দায়িত্ব পাইয়া সইদ গইরুল হাসান রিজভি সংখ্যালঘুদের জন্য হেল্পলাইন খুলিবার প্রস্তাব দিয়াছেন। তাঁহাদের দ্বিতীয় বক্তব্য, যদি সংখ্যাগুরুর জন্য কমিশন না তৈরি করা হয়, তবে এখনই সংখ্যালঘু কমিশন উঠাইয়া দেওয়া হউক। অসহিষ্ণুতা যে কোনও যুক্তি বা ভব্যতার ধার ধারে না, আবার প্রমাণ হইল। প্রথমত, হেল্পলাইন বিষয়টি লইয়া এত উত্তেজিত হইবার কারণ বোঝা দায়। ইহা অশান্তিতে মদত দিবার ব্যবস্থা নয়, অশান্তি হইলে তাহা জানিবার প্রকরণ। ভারতের সংখ্যালঘুদের কোনও অশান্তিতে না পড়িতে হইলেই ভাল হইত, হেল্পলাইন ব্যবহারের প্রশ্নও উঠিত না। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে পরিস্থিতি তেমন নহে, গত তিন বৎসরের বিজেপি শাসনকালে পরিস্থিতি আরওই উৎপীড়ক হইয়া উঠিয়াছে। কমিশনের ঠিক এই কাজই করিবার কথা। ভারতে অনেক সময়ই সরকারি কমিশনগুলি যথেষ্ট সক্রিয় হয় না, সমস্যা ইহাই। অথচ সরাসরি অভিযোগের সুবিধা থাকিলে কমিশন দ্রুত তদন্ত করিতে পারে। পদ্ধতিগত স্বচ্ছতা থাকিতে পারে। রিজভি ঠিক সেই প্রস্তাবই করিয়াছেন। প্রশাসনিক আশ্বাসের হাতটি বাড়াইয়াছেন। সামান্য এই বন্দোবস্ত লইয়া যাঁহারা এতটা উৎকণ্ঠিত ও বিক্ষুব্ধ, তাঁহারাই সাক্ষাৎ প্রমাণ— কেন হেল্পলাইনের প্রয়োজন এত বেশি।

ফলত তথা দ্বিতীয়ত, এই জন্যই সংখ্যালঘু কমিশনের প্রয়োজন আছে, সংখ্যাগুরু কমিশন বলিয়া কিছু হয় না। এই একটি অর্বাচীন তর্ক হিন্দুত্ববাদীদের মুখে শুনিয়া শুনিয়া কান পচিবার উপক্রম যে সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকিলে সংখ্যাগুরুদের জন্য কেন থাকিবে না? ঘটনা হইল, প্রতিটি নাগরিকেরই যদিও অত্যাচারিত হইবার এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাইবার অধিকার আছে, সরকারি দফতরগুলিতে তদানুযায়ী ব্যবস্থাও আছে। তবু মানবাধিকার কমিশন সত্ত্বেও সংখ্যালঘু কিংবা নারী-শিশু কমিশনের আলাদা ভাবে প্রয়োজন পড়ে, কেননা এই গোষ্ঠীগুলি সামাজিক ক্ষমতাতন্ত্রে এখনও প্রান্তিক অবস্থানে বিরাজমান। সামাজিক ক্ষমতার তারতম্যের কারণেই অত্যাচার ও সংকটের প্রকারভেদ ঘটিয়া যায়। সরকারি নজরদারিতেও এই ক্ষেত্রগুলিতে বিশেষ মনোযোগের দরকার হয়। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের সংবিধানে তাই আলাদা করিয়া সংখ্যালঘুদের জীবন ও সংস্কৃতি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছে। ‘সব নাগরিক’-এর সামান্যীকরণের ঊর্ধ্বে উঠিয়া সেই প্রতিশ্রুতি উচ্চারিত।

অবশ্য এই সবই যুক্তি-বুদ্ধির কথা। যাঁহারা ‘সংখ্যালঘুর সহায়তা’ শব্দবন্ধের মধ্যেই নিশ্চিত ভাবে, সম্মেলক ভাবে পাকিস্তানের ভূত দেখিবার জন্য বসিয়া আছেন, তাঁহাদের প্রতি এহেন যুক্তিবাক্য বর্ষণ নেহাত সময় নষ্ট। পরিষদ বস্তুত সংখ্যালঘুকে ক্ষমতাতন্ত্রে আরও প্রান্তিক করিতেই চব্বিশ ঘণ্টা ব্যয় করিতেছে। এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশ্রয়ে ও আশ্রয়ে সেই স্পর্ধা উত্তরোত্তর অকুণ্ঠিত ও প্রকাশ্যতর হইতেছে। সুতরাং অভাবনীয়ও ঘটিতে পারে, পরিষদের প্রস্তাব একেবারে মাঠে মারা না-ও যাইতে পারে। এ দেশের সাংবিধানিক উদারতার পায়ে এক এক করিয়া কতিপয় কুঠারাঘাত ইতিমধ্যেই ঘটিয়াছে। সংখ্যালঘু কমিশন কুঠারলক্ষ্য হইতে বাঁচিবে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Social power Marginal position
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE