ভারতীয় নারীর ব্যক্তি-অধিকার আছে, এবং তাহার নিজের জীবন বিষয়ে সিদ্ধান্ত লইবার অধিকার সেই বৃহত্তর ব্যক্তি-অধিকারের মধ্যে পড়ে। গণতান্ত্রিক দেশের সাংবিধানিক অধিকারের স্বরূপ লইয়া গত কিছু কাল যাবৎ যে হতবাক বিভ্রম তৈরি হইয়াছিল, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই ঘোষণাটি ধ্বনিত হওয়ায় তাহাতে বিরাট আশ্বাসের প্রলেপ পড়িয়াছে। সত্য বলিতে, এই রায়টিতে বিস্ময়ের কিছু নাই। বরং, ২৫ বৎসর বর্ষীয়া হাদিয়া ইচ্ছাপূর্বক শাফিন জাহানকে বিবাহ করিয়াছিলেন, সুতরাং সেই বিবাহ আইনত সিদ্ধ— এই সামান্য কথাটি বলিবার জন্য যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবধি যাইতে হইল, ইহাকেই সাম্প্রতিক কালের আশ্চর্য ঘটনাগুলির অন্যতম বলা চলে। হাদিয়ার নিজ মুখের বয়ান সত্ত্বেও এই বিবাহ হাই কোর্টে অসিদ্ধ ঘোষিত হইয়াছিল, তাহাও এই বিস্ময়সরণির একটি মাইলফলক। হাদিয়া জন্মসূত্রে হিন্দু, তবু ধর্মপরিবর্তন করিয়া মুসলিম যুবককে বিবাহ করিয়াছেন, তাই হাদিয়া তথা অখিলার পিতা বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণের অভিযোগ আনিয়াছিলেন, হাদিয়ার স্বামীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জঙ্গি যোগাযোগের অভিযোগও তুলিয়াছিলেন। শেষ পর্যন্ত কেরল হাই কোর্ট অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করিয়া ‘লাভ জিহাদ’-এর ধারণাটিকে বিচারবিভাগীয় স্বীকৃতি দেয়। এত দিনে সুপ্রিম কোর্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সেই স্বীকৃতি নাকচ করিয়া দুই বয়ঃপ্রাপ্ত নরনারীর স্বেচ্ছাবিবাহকে গণতান্ত্রিক অধিকার হিসাবে মান্য করিল।
উদ্দেশ্যভিত্তিক অপপ্রচার যে সমাজ-মানসের কত গভীরে গিয়া ক্ষতি সাধন করে, হাদিয়ার কাহিনিটি তাহার উদাহরণ। এই বিবাহ ভিন্নধর্মের দুইটি মানুষের মধ্যে হইয়াছে। তাঁহাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে হিন্দু সমাজের উপর ইসলামি আক্রমণের দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখানো এখন সহজ। এই সমস্যা আজ সর্বব্যাপীও বটে। লাভ জিহাদের মূল ধারণাটি উত্তর ভারতের রক্ষণশীলতম হিন্দু বলয় হইতে উৎসারিত হইলেও এখন ইহা গোটা দেশের সমাজমানসের নিকট গ্রহণযোগ্য, এমনকী আদালত চত্বরেও। ঘটনাটির মধ্যে মুক্তমনা নাগরিককে অবশ করিয়া দেওয়ার মতো ভীতি ও উদ্বেগের উপকরণ রহিয়াছে। সংখ্যাগুরু ধর্মসমাজের আস্ফালন ও আক্রমণ কোথায় পৌঁছাইলে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হইয়া উঠিতে পারে, তাহার প্রতীক হইয়া রহিলেন হাদিয়া।
পশ্চাৎপদতা বা রক্ষণশীলতার বৈশিষ্ট্য, তাহা কোনও একটিমাত্র ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না, সুনামিপ্রবাহের মতো ধাইয়া আসিয়া সমাজের সমস্ত দিকের মুক্তিকে গ্রাস করিয়া ফেলে। তাই, মুসলিম-বিদ্বেষের সহচর হিসাবে নারীবিদ্বেষও হাদিয়া কাণ্ডের একটি মৌলিক উপাদান। হাই কোর্টের রায়টিতে নারীকে কার্যত তাহার পরিবারের সম্পত্তি বলিয়া ঘোষণা করিয়া তাহার সমস্ত সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা হরণ করা হইয়াছিল— নারী দুর্বল, তাই বয়ঃপ্রাপ্তিতেও তাহার নিজের উপর স্বাধীনতা থাকিতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসংখ্য ধন্যবাদ যে, তাঁহারা মনে করাইয়া দিলেন, নারীর জীবনের পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকার সমাজের একটি মৌলিক দায়, এমনকী তাহার ভুল সিদ্ধান্ত লইবার স্বাধীনতাতেও বাধা দান চলিবে না। সর্বোচ্চ আদালতের এই কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান ভারতের প্রেক্ষিতে তাহার গুরুত্ব দ্বিগুণ। বয়ঃপ্রাপ্ত নাগরিক ঠিক কাজ করুক, ভুল কাজ করুক, যতক্ষণ না সে অন্য কাহারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করিতেছে, ততক্ষণ তাহার উপর রাষ্ট্র বা সমাজের খবরদারি চলিবে না, ইহাকে নিঃসন্দেহে মুক্ত সমাজের গোড়ার আদর্শ বলা যায়। নরেন্দ্র মোদীর দেশে এই আদর্শ যখন দ্রুতবেগে বিলীয়মান হইতেছে, এমন এক সময়ে সর্বোচ্চ আদালতের গভীর আশ্বাসবাণীটি ভাসিয়া আসিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy