Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সময় এসেছে ধর্ম না দেখে বিপন্নের পাশে দাঁড়ানোর

পিতৃতর্পণ করব বলে প্রশান্ত মহাসাগরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। আর অন্যমনস্ক ভাবে এগিয়ে এসেছি বেশ অনেকটা। হঠাৎ একটি রীতিমত আক্রোশী ঢেউ।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৭ ০০:১৫
Share: Save:

ইন্টারন্যাশনাল রাইটার্স প্রোগ্রামে যোগ দিতে আইওয়া গিয়েছিলাম ২০১৪ সালে। লেখকদের সবার জায়গা হয়েছিল একটা চারতলা বাড়িতে। দোতলায় থাকতাম আমরা ন’জন। তার মধ্যে গ্রিসের অগাস্টাস আর আমাকে বাদ দিয়ে বাদবাকি সবাই ছিল মুসলমান। সেখানেই এক অচ্ছেদ্য বন্ধুতায় জড়িয়ে যাই আফগানিস্তানের মুজিব, ইরাকের সাদেক, সৌদি আরবের আবদাল্লা, মিশরের আহমেদ, সিরিয়ার কিনানা ইসা, সুদানের সাবা-র সঙ্গে। আইওয়ার খোলা মাঠে একটাই ঘোড়ার পিঠে আমার আর মুজিবের ছবিটা আইওয়া ফেস্টিভালের সেরা ছবির একটা হয়েছিল।

কিন্তু যে ছবিগুলো ফেস্টিভালে যায়নি তাদের একটার কথা বলি। সে-বার মহালয়ার দিন আমি সান ফ্রানসিসকোতে। পিতৃতর্পণ করব বলে প্রশান্ত মহাসাগরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। আর অন্যমনস্ক ভাবে এগিয়ে এসেছি বেশ অনেকটা। হঠাৎ একটি রীতিমত আক্রোশী ঢেউ। আমি মুখ থুবড়ে পাথরে পড়ার আগেই যে হাতটা আমায় ধরে ফেলল, সেটা সাদেকের। তার পর আমি সমুদ্রের ভিতরের একটা পাথরে বসে যত ক্ষণ তর্পণ করলাম আমাকে ধরে রইল সাদেক। এ-বার সেই সাদেককেই যখন ছোট একটা এয়ারপোর্টে চোরের অপমান করা হচ্ছে তখন আমি চুপ থাকতাম কী করে? শুধু এয়ারপোর্ট কেন, অপমান ওদের শপিং মল থেকে মিউজিয়ম, অনেক জায়গাতেই করত। সিকিয়োরিটি চেক-এর নামে, “ইউ পিপল ওপেন ইয়োর শার্টস” শুনতে শুনতে কান পচে গিয়েছিল। কিন্তু সে-বার সেই বিমানবন্দরে এক জন চিনে অফিসার (হয়তো নিজেকে একটু বেশি আমেরিকান দেখাতে চেয়ে) সাদেককে প্যান্ট খুলতে বলে। সাদেক খুলতেই যাচ্ছিল, কিন্তু ওই ‘ইসলামোফোবিয়া’ তত ক্ষণে আমার সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। আমি নিজের শার্ট খুলতে খুলতে গলা তুললাম, “প্লিজ চেক মি অলসো। আই হ্যাভ ডিসাইডেড টু এমব্রেস ইসলাম”। চমকে গিয়েছিল লোকটা। আরও চমকে গিয়েছিল আমার সঙ্গীরা। সে-দিন বিকেলে আইওয়ায় ফেরার পথে ওরা ওদের নিজেদের জীবনের গভীর-গোপন গল্পগুলো তুলে ধরতে শুরু করল আমার কাছে। শুধু সে-দিনই নয়, তার পর কত কত রাত কারও একটা ঘরে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে গেছি; কোনও দিন আবদাল্লার তো কোনও দিন মুজিবের। আর আমার প্রত্যেকটা স্বপ্নের শেষ দৃশ্যে আজানের শব্দ এসে মিশেছে।

না, আমার কোনও অসুবিধে হয়নি। কারণ তত দিনে আজানের ভিতরের কান্নাটা আমি চিনতে শিখেছি। আমি জেনেছি, মুজিবের পরিবারের এক-তৃতীয়াংশ খতম হয়ে গেছে তালিবানের গুলিতে। সাদেক নিজের প্রথম স্ত্রীকে হারিয়েছে আইসিস-এর অত্যাচারে। “আমার মাইগ্রেনের ব্যথা হিজাব জড়ালেই বেড়ে যায়” বলে হাসতে থাকা কিনানার কাছে রোজ দামাস্কাস থেকে প্রেমপত্র আসে, “ফিরলেই খুন হবি”; শুনেছি, মুখ না ঢেকে রাস্তায় বেরোনো সাবাকে কারা যেন অ্যাসিড ছুড়েছিল, আহমেদ ব্যান্ডে গান গায় বলে নিজের শহর থেকেই নির্বাসিত। ইসলামিক মৌলবাদের কী ভীষণ মূল্য যে মুসলমানদের দিতে হয়, আইওয়া না গেলে জানতে পারতাম না।

ওদের কেউ বলত, “নিউ ইয়র্কে রিকশা চালানোর পারমিট পেলেও আর ফিরব না”; অন্য কেউ বলত, “ইন্ডিয়ায় থাকার একটা ব্যবস্থা করে দাও, আমরা ইন্ডিয়ার হয়ে ফাইট করব।” আমি অবাক হতাম, “ইন্ডিয়ার সঙ্গে কারও যুদ্ধ তো চলছে না এখন”, আর ওরা আরও বেশি অবাক হয়ে আমায় বলত, “তোমরা জানো না?”

সেই আমি জানতে শুরু করলাম, আইসিস তুরস্ক থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত এক খিলাফতের স্বপ্ন ফিরি করতে শুরু করেছে মধ্যপ্রাচ্যে, আফগানিস্তান-পাকিস্তানে। এই ধর্মরাজ্যের পথে একমাত্র বাধা ভারত; ভারত নামের উইকেটটা পড়ে গেলেই মায়ানমার কিংবা তাইল্যান্ডকে পেড়ে ফেলা কোনও ব্যাপা্র? আজ যখন দেখি হায়দরাবাদ থেকে, কেরল থেকে, লখনৌ থেকে তরতাজা যুবকরা ধরা পড়ছে যাদের শরীরটা ভারতে কিন্তু মাথাটা আইসিস-এর কবজায়, তখন ভাবি, কত দিন আগে সতর্ক করতে চেয়েছিল মুজিবরা।

সতর্ক করতে চাইলেও যাঁরা সতর্ক হন না, যাঁরা বিশ্বাস করেন অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ থাকবে, সেই পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করি, ওয়াহাবি ভাবধারা প্রচারের জন্য ভারতে ঠিক কত হাজার কোটি টাকা ঢুকেছে আপনারা জানেন? জানেন কি, সেই টাকা দিয়ে কী-ভাবে মানসিকতা বদলে ফেলার কাজ চলছে অলিতে-গলিতে? চলছে বলেই আমার সহপাঠী, বাংলা ভাষার এক উল্লেখ্য কবি যখন প্রধান শিক্ষক হিসেবে একটি মাদ্রাসায় যোগ দিতে যায় তখন হাওড়া জেলায় বসে অপরিসীম স্পর্ধায় তিন জন লোক তাকে জিজ্ঞেস করতে পারে, “পুতুল পুজো করবেন বলে এখানে জয়েন করতে চাইছেন?” বৈধ নিয়োগপত্র থাকা সত্ত্বেও সেই মাদ্রাসায় যোগ দিতে পারে না সে, কারণ মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ ওকে কেবলমাত্র হিন্দু ঠাওরান, শিক্ষক নয়।

কে বলবে এগুলোর বিরুদ্ধে? আমি নিজেই কি বলেছি? বলিনি বলেই মাথা নিচু হয়ে গেল যখন মল্লারপুরের একটি ছেলে বইমেলায় আমাকে বলল, “দাদরির পর আপনি খবরের কাগজে লিখেছিলেন, কিন্তু কই আমাদের ইন্দ্রজিৎকে যখন পিটিয়ে মেরে দিল, তখন কিছু লিখলেন না তো?”

কে ইন্দ্রজিৎ? আখলাখের মতো তাকেও পিটিয়ে মারা হয়েছে? জানি না তো! কোথায় ধূলাগড়? উস্তি-ক্যানিং-কালিয়াচক-সমুদ্রগড়-দেগঙ্গা কোথায়? এই পৃথিবীতে? সেখানে যাদের বাড়ি পোড়ানো হয়েছে তারা কারা? মানুষই তো?

আসলে গোড়ায় গলদ। গুজরাত দাঙ্গার পর দু’মাসের মাইনে দিয়েছিলাম। হেঁটেছিলাম বেশ অনেকগুলো মিছিলে। (তখনও জুকেরবার্গ ফুটেজ-বিপ্লবী হওয়ার সুযোগ করে দেননি)। তা সেই মিছিলের কয়েকটায় মহম্মদ সেলিম নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কই সেলিম সাহেবকে কেউ মুসলিম সাম্প্রদায়িক বলেনি তো! আইনস্টাইন যখন রুজভেল্টকে চিঠি লিখেছিলেন ইহুদিদের বাঁচাবার জন্য, কেউ কি তাঁকে ইহুদি-সাম্প্রদায়িক বলেছিলেন? মার্টিন লুথার কিং যে শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের মোকাবিলা করার জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের একে অপরের প্রতি “এক্সট্রিম ইন লাভ” হয়ে উঠতে বলতেন, তার জন্য কি কেউ বলেন যে উনি কৃষ্ণাঙ্গ সাম্প্রদায়িক? তা হলে নোয়াখালি আর নাসিরনগরের যে লোকগুলো মরছে আর পালিয়ে আসছে গত সত্তর বছর ধরে, কাশ্মীরের যে পণ্ডিতগুলো দিল্লির রাস্তায় কাতরাচ্ছে গত পঁচিশ বছর, তাদের যন্ত্রণাতেও কারও বুকটা টনটন করে উঠলে সে তৎক্ষণাৎ বিজেপি বলে চিহ্নিত হয় কেন? বিপন্ন হিন্দুর বেঁচে থাকার অধিকার কি শুধুমাত্র বিজেপি স্বীকার করে? ভারতের আর কোনও রাজনৈতিক দল করে না?

এখানেই শেষ কথাটা বলার। বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো-সরস্বতীপুজো-বারের উপোস, নাতির পইতে, দাদুর শ্রাদ্ধ, সব কিছু করার পরে ফেসবুকে নিজেকে ‘নাস্তিক’ দাবি করার এলিটিস্ট ভণ্ডামি এক জন মুসলমান কল্পনাও করতে পারেন না। পারেন না বলেই, কোথাও কোনও মুসলমান অত্যাচারিত হলে তিনি বুক চিতিয়ে তার পাশে দাঁড়ান। দাঁড়ান এক জন মানুষের পাশে আর এক জন মানুষের যে-ভাবে দাঁড়ানো উচিত, সে-ভাবেই। প্রাজ্ঞ হিন্দুরা কবে এক জন অত্যাচারিত হিন্দুকেও মানুষ ভাবতে পারবেন? কবে বলতে পারবেন, সতেরো জন হিন্দু সন্ন্যাসীকে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারা অন্যায় হয়েছিল? কবে আমি দেগঙ্গা কিংবা ক্যানিং-এর রাস্তায় দাঁড়িয়ে, চিৎকার করে বলতে পারব, “প্লিজ পানিশ মি অলসো। আই হ্যাভ ডিসাইডেড টু কল মাইসেলফ, আ হিন্দু”।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Secularism Hindu Muslim religion endangered
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE